অনাবৃষ্টি,অতিবৃষ্টি তাপদাহের পর লোডশেডিং সিলেটের চা শিল্পের জন্য অশনি সংকেত
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ লাগাতার অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও প্রচন্ড তাপদাহ, এখন লোডশেডিং-এ যেন ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’ সিলেটের চা শিল্পের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। চায়ের ভরা মৌসুমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ। এতে চায়ের গুণগত মান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়বে রপ্তানি বাজারে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর দিয়ে চা উৎপাদনে বাড়ছে অধিক খরচ। আর তার জেরে মাথায় হাত চা বাগানের সঙ্গে যুক্তদের।সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানের ব্যবস্থাপকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চায়ের মৌসুম শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে আর শেষ হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে। চা উৎপাদনের পিক সিজন হচ্ছে জুন, জুলাই ও আগস্ট-এই তিন মাস। এই পিক সিজনে প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে ৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘন্টা সময় লাগে। এ কারণে ২৪ ঘন্টা কারখানা চালু রাখতে হয়। তারা বলছেন, বর্তমানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চা বাগানের কারখানাগুলোর সকল মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান। চায়ের মান খারাপ হলে চা পাতা রপ্তানিও করা যাবে না। আবার রপ্তানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কা থাকবে। তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মর্যাদাহানি ঘটবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, দেশে মোট ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান আছে। এরমধ্যে সিলেট বিভাগে ১৩৫টি বাগান রয়েছে। সিলেটে ১৯টি, মৌলভীবাজারে ৯১টি ও হবিগঞ্জে ২৫টি চা বাগান রয়েছে।ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা আসাম এলাকায় প্রথম চা চাষ শুরু করেছিল। ১৮৫৪ সালে সিলেটের বিমানবন্দর রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগানের কার্যক্রম শুরু করে ব্রিটিশরা। এখানেই বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনে সাফল্য আসে। এ হিসাবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা বাগান বলা হয় মালনীছড়াকে।বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, গত ৫ বছরের মধ্যে দেশে ২০১৭ সালে ৭৪.৯৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ২.৫৬ মিলিয়ন কেজি। ২০১৮ সালে চা উৎপাদন হয়েছে ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজি। এই বছর রপ্তানি হয়েছে ০.৬৫ মিলিয়ন কেজি। ২০১৯ সালে ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ০.৬০ মিলিয়ন কেজি। ২০২০ সালে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ২.১৭ মিলিয়ন কেজি। ২০২১ সালে ৯৬.৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ০.৬৮ মিলিয়ন কেজি।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও নর্থ সিলেট ভ্যালির চেয়ারম্যান নোমান হায়দার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে একসময় দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র বদলে গেছে। চা শিল্প এখন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিরিক্ত খরতাপ, অনাবৃষ্টি, উত্তরাঞ্চলে অপরিকল্পিত চায়ের চাষাবাদ, উৎপাদিত চায়ের প্রকৃত মূল্য না পাওয়ায় বাগান মালিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এবার চা উৎপাদনের পিক সিজনে লোডশেডিং চা শিল্পে বিপর্যয়ের ঘন্টা বাজাচ্ছে।তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে লোডশেডিংয়ের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করলেও ঘোষিত সময় মানা হচ্ছে না। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এতে জেনারেটর চালু করতে সময় লাগছে। আবার বিদ্যুৎ আসলে মেশিন নতুনভাবে চালু হতেও সময় লাগছে। এতে উৎপাদন প্রক্রিয়া ঢিলে হওয়ায় ধারাবাহিক প্রসেসিংয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সময়ও নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি চায়ের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেল। ডিজেলের লিটার ৮৫ টাকা। কিন্তু সেই ডিজেলও চাহিদামত পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর সরকার আবার বলেছে পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে। যে কারণে জেনারেটর চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না।মালনীছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আজম আলী বলেন, বাগান থেকে চা পাতা চয়নের পর ৭ থেকে ৮ ধাপে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে প্রতি ধাপের আলাদা মেশিনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকতে হয়। বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের পর কাঁচা পাতা ফ্যান চালিয়ে একটানা ছয় থেকে সাত ঘন্টা টার্ফে রাখতে হয়। তারপর মেশিনে তুলতে হয় তখন যদি একঘণ্টা চলার পর মেশিন বন্ধ হয়ে যায়; তাহলে পাতা মেশিনে আটকে নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন, গত রোববার সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ভেজা চা পাতা উত্তোলনের পরই একটানা ছয় থেকে সাত ঘন্টা টার্ফে রাখতে হয়। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে সেটা পারছি না। এই সমস্যার জন্য চায়ের গুণগতমান কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জাফলং চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. কামাল হোসাইন বলেন, সঠিক সময়ে খুব সচেতন ভাবে বিভিন্ন ধাপ অনুয়ায়ী চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় কিছু হেরফের ঘটলেই চায়ের গুণগত মান ঠিক থাকে না। বিদ্যুতের লোডশেডিং-এর কারণে জেনারেটর দিয়ে সবকিছু সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। এভাবে চা প্রক্রিয়াজাত করলে গুণগত মান নষ্ট হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।বিদ্যুৎ বিভাগ সিলেট অঞ্চলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল কাদির গণমাধ্যমকে বলেন, চা বাগানের ফিডারগুলোর সাথে বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। তাই আলাদাভাবে বাগানে বিদ্যুৎ সচল রাখা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে লোডশেডিংয়ের সময় তাদেকে নিজস্ব জেনারেটর দিয়েই কাজ চালাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ২৩টি দেশে চা রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, জাপান, ভারত ও সুইজারল্যান্ড রয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চায়ের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, রফতানি বাজার সম্প্রসারণ, গুণগত মানসম্পন্ন চা উৎপাদন বৃদ্ধি, চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার উন্নয়নের পথনকশাঃ বাংলাদেশ চা শিল্প প্রণয়ন করেছে। এ পথনকশা ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার অনুমোদন করে। এতে স্বল্পমেয়াদি (২০১৬-২০২০), মধ্যমেয়াদি (২০১৬-২০২৫) ও দীর্ঘমেয়াদি (২০১৬-২০৩০) মোট ১১টি কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় নাম লেখাতে চায়। কিন্তু লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা।বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান নোমান হায়দার চৌধুরী বলেন, চা জাত পণ্য থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্বিঘেœ আদায় করে। চায়ের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে মালিক, শ্রমিক পক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নিলামে যে চা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়; বাজারে ভোক্তার কাছে সেই চা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা। মূল্যের এই তারতম্য কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া, চা-বোর্ডকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। কৃষিপণ্যের মতো সারের ভর্তুকি ও কৃষিঋণ দিতে হবে। তবেই চা শিল্পে সুফল পাওয়া যাবে।