আবারও দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস

সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ
 সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। টাকার বিনিময়ে সেবাপ্রার্থীদের আবেদনপত্রে বিশেষ ‘মার্কা’ বসিয়ে করে দিচ্ছেন পাসপোর্ট। একইভাবে পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান ও নগরের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি বাড়তি টাকা নিয়ে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পাসপোর্টের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে গড়ে ওঠা ১০/১২টি কম্পিউটার দোকান ও শহরের বিভিন্ন মার্কেটের অন্তত কয়েক শ’ ট্রাভেল এজেন্সি প্রকাশ্যে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে পাসপোর্ট তৈরি ও নবায়নের কাজ করে থাকে। এসব জায়গায় গিয়ে পাসপোর্ট করার কথা বললেই তারা সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়ে পাসপোর্টের কাজ করে দেন।
নগরির ইদ্রিস মার্কেট, সুরমা টাওয়ার, রংমহল টাওয়ারের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা একটা পাসপোর্টের ফরম ফিলআপ, টাকা পেমেন্ট ও সার্ভিস দিয়ে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পাই। অথচ সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি নিতে হয়। এরমধ্যে পাসপোর্ট অফিসের মার্কা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনে লাগে আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ ৪৮ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য একজন গ্রাহককে সর্বনিম্ন ৬৮০০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকা খরচ করতে হয়। বইয়ের আকার ও মেয়াদে টাকার পরিমাণ বাড়ে। এই টাকা না দিলে পাসপোর্ট অফিসে সেবাপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হন। কারণ টাকা দিলেই সেবাপ্রার্থীর আবেদনপত্রের ই-মেইলের জায়গায় বিশেষ ই-মেইল দেয়া হয়। এটিই পাসপোর্ট অফিসের বিশেষ চিহ্ন বা মার্কা। এটি নতুন কিছু না, ওপেন সিক্রেট।
পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৫ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতি জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং ১০ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতি জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুণতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের ১০৮ নম্বর কাউন্টারে আবেদনপত্র জমা নেয়া হয়। ওই কাউন্টার থেকে প্রত্যাখ্যান হওয়া আহমদ হোসেন বাপ্পী নামে এক সেবাপ্রার্থী বলেন, আমি নিজে নিজে আবেদনপত্র ও পেমেন্টের কাজ করেছি। এখানে আসার পর তারা আমার কাগজপত্র সংকট দেখিয়ে জমা নেননি। আমি বুঝতে পেরেছি আমি তাদের মার্কার সিস্টেমে আসিনি তাই এ রকম হচ্ছে। দেখি যদি না হয় তবে তাদের মার্কার সিস্টেমে আমি আসবো। কারণ আমার বিদেশ যেতে হলে পাসপোর্ট দরকার।
নতুন পাসপোর্ট করতে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন মশাহিদ আলী নামে এক ব্যক্তি। পাসপোর্টের আবেদনপত্র নিজে নিজে পূরণ করে অনলাইনে ফি পরিশোধ করেছেন তিনি। পরবর্তীতে পাসপোর্ট অফিসে আবেদনপত্র জমা দেয়ার ১০৮ নম্বর কাউন্টারের সামনে যান মশাহিদ আলীসহ এক গণমাধ্যম কর্মী। সেখানে দায়িত্বে থাকা পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা প্রায় ১৫ মিনিট মোবাইলে কথা বলা শেষ করে বিভিন্ন কাগজপত্র নেই এমন অজুহাতে তার আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি বলেন, আপনার কাগজপত্র ঠিক নেই। ঠিক করে নিয়ে আসেন তখন কাগজ জমা নেবো।
এরপর পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকে দায়িত্বে থাকা পলাশ নামে এক আনসার সদস্য আড়াই হাজার টাকায় বিষয়টি সুরাহা করতে পারবেন বলে জানান। অনেক দেন-দরবার করে শেষে ২ হাজার টাকায় চুক্তিতে রাজি হন তিনি। এরপর ১০৮ নম্বর কাউন্টারের ভেতরে গিয়ে নিমিষেই সিল মেরে আবেদনকারী ব্যক্তির ফরমের ই-মেইলের স্থানে বিশেষ মার্কা নিয়ে আসেন তিনি। এরপর ১০৩ নম্বর রুমে গিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি দিতে বলেন আনসার সদস্য পলাশ। তিনি বলেন, সেখানে দুলাল ফরাজী নামে আরেক আনসার সদস্য তাকে (আবেদনকারীকে) সহযোগিতা করবেন।
এ সময় বিশেষ মার্কার জন্য পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তি ২ হাজার টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তার পথ আটকে দিয়ে পিছু নেন আনসার সদস্য দুলাল ফরাজী ও পলাশ। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে মুহূর্তেই ভোল পাল্টান দু’জন। মোবাইলে থাকা প্রমাণ দেখালে চুপসে যান তারা। একপর্যায়ে আকুতি-মিনতি করতে থাকেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ওই আনসার সদস্যরা।
পাসপোর্ট অফিসে মার্কা ও টাকা লেনদেন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট’র সভাপতি ফারুক মাহমুদ সুজন গণমাধ্যমকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ লেনদেন ও মার্কার বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন, সেখানে এই ধরণের কার্যক্রম সরকারকে বিতর্কিত করছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের অপকর্মের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে গোয়েন্দা সংস্থা, দুদকের কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হোক দুর্নীতিবাজদের ধরতে।
পাসপোর্ট অফিসের মার্কার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ গণমাধ্যমকে বলেন, মার্কার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা সকলকেই সমানভাবে সেবা দিয়ে থাকি। প্রতিদিনকার আবেদন প্রতিদিনই শেষ করার নির্দেশনা দেয়া আছে আমাদের।
কাগজপত্র ঠিক নেই বলে প্রত্যাখ্যান হওয়া আবেদনপত্র টাকা দিলে কীভাবে গ্রহণ করা হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে একটু সময় দেন। আমি এ বিষয়ে কাজ করছি। কাউন্টারে এ রকম হলে তাকে (দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে) আমরা সরিয়ে দেব।
আনসার সদস্য পলাশ ও দুলাল ফরাজীর দালালের ভূমিকায় কাজ করার ব্যাপারে মহের উদ্দিন শেখ বলেন, আমরা এ ধরণের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তাদেরকে এমনিতেই ৬ মাসের বেশি আমরা পাসপোর্ট অফিসে রাখি না। পর্যায়ক্রমে তাদের অদল বদল করা হয়।
এদিকে, টাকার বিনিময়ে সেবাপ্রার্থীদের আবেদনপত্রে বিশেষ ‘মার্কা’ বসিয়ে পাসপোর্ট করে দেয়ার অভিযোগে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে দায়িত্বরত ২ আনসার সদস্যকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
৭ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অভিযুক্ত আনসার সদস্যরা হলেন, দুলাল ফরাজি ও মো. হাসান আলী ওরফে পলাশ।
সম্প্রতি জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের।
সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ জানান, প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আনসার সদস্যদের সরিয়ে নেয়ার জন্য আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সিলেট জেলা কমান্ড্যান্টকে লিখিতভাবে জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দু’জনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সিলেট জেলা কমান্ড্যান্ট আলী রেজা রাব্বী বলেন, পাসপোর্ট অফিসের চিঠি পাওয়ার পর নিয়মানুসারে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ তদন্তের জন্য আমাদের একজন অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই রিপোর্ট আসার পর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইতোমধ্যেই পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্বরত ২ জনকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

You might also like