কেমন করে বেঁচে আছি এই করোনায়: পর্ব-২

 দিলীপ মজুমদার

আমি যদি শক্তিমান লেখক হতাম,তাহলে করোনাভাইরাস ও তার সংক্রমণকে কেন্দ্র করে একটা মহাকাব্য অথবা মহাকাব্যোপম উপন্যাস লিখে ফেলতাম।অবশ্যই সে উপন্যাসের নায়ক হত করোনা।তার অদৃশ্য অথচ অসীম শক্তির কথা বলতাম।বলতাম যে বহু লক্ষ বছর আগে অন্যান্য ভাইরাসের মতো করোনাও এসেছিল পৃথিবীতে । কি করে এসেছিল,সে রহস্য অবশ্য বলতে পারতাম না।মানুষ তাকে না ঘাঁটালে সে চুপচাপ থেকে যেত।হয়তো পশু-পাখি নিয়ে খেলা করত।তাকে ঘাঁটিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনল মানুষ।বুঝতে পারে নি একরত্তি একটা অণুজীবের এত তেজ হবে ।

কুমুদরঞ্জন মল্লিকের একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল।ছোটর দাবি’ ।বলতাম, ছোটকে উপেক্ষা করা ঠিক নয় ।জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে / তুমি বিচিত্ররূপিণী ।রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদেবতা বা মানসসুন্দরী সম্বন্ধে বলেছিলেন । এ কথা করোনা সম্পর্কে বলা যায় অনায়াসে । দেশে দেশে কত বিচিত্র রূপে সে যে দেখা দিচ্ছে।এতদিন জানা ছিল করোনাভাইরাসের গায়ের স্পাইক কাঁটাগুলো সংক্রমণের মূল।সংক্রমিত হবের পরে মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তা শেষ করে স্পাইক প্রোটিনকে।কিন্তু জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন স্পাইক প্রোটিনকে শেষ করা এত সহজ নয় । কারণ অ্যান্টিবডিকে রুখে দেবে ভাইরাসের বর্মবস্ত্র।মানুষকে নাজেহাল করার জন্য করোনা বর্ম পরে নিয়েছে ।

কমলির মতো করোনা যেন কিছুতেই ছাড়বে না মানুষকে।করোনা থেকে সুস্থ হবার পরে ফুসফুসে ফাইব্রোসিস দেখা যায়, অক্সিজেন কমে, সমস্যা দেখা যায় কিডনির।ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট আকিকো ইওয়াসাকি আরও এক সংঘাতিক কথা জানিয়েছেন ।বলেছেন,করোনা মানুষের মস্তিষ্কে থাবা বসায়।যার ফল মাথার যন্ত্রণা, বিভ্রান্তি ও বিস্মৃতি ।নানা সময় নানা কথা বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ।সেদিন তারা বলল, আগামী দু বছরে পৃথিবী করোনা মুক্ত হবে ।বিশ্বাস হয় না ।ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মার্ক ওয়ালপোল বলে দিয়েছেন, করোনা সহজে যাবার নয় ।তাই তো দেখছি । জাপানের মতো দেশ করোনাকে কিছু ঠেকিয়ে রাখলেও অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের নানা দেশে নতুন সংক্রমণের ঢেউ শুরু হয়েছে।ব্রাজিল,মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকার পাঁচ দেশে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী ।ভারতের অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা,দিল্লি,মহারাষ্ট্রে লেগেছে করোনার তৃতীয় ঢেউ ।

এরকম অবস্থায় একটা বোমা ফাটিয়েছেন এক চিনা বিজ্ঞানী । তিনি হলেন লি মেং ইয়ান । চিনা ভাইরোলজিস্টতিনি । হংকংয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথএ সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি । প্রাণের ভয়ে তিনি চিন থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায় । ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন উহানে চিনের সরকারি ল্যাবে তৈরি হয়েছে নোভেল করোনাভাইরাস । এতে চিনা সেনাদের হাত আছে । ইয়ান বলেন, ‘ এই ভাইরাস কোনভাবে প্রাকৃতিক নয় । আমি গবেষণা করে যা বুঝেছি, তাতে হয়তো বাদুড় বা ওই জাতীয় কোনও প্রাণীর থেকে ভাইরাল স্ট্রেন নিয়ে তাকে রাসায়নিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে, যাতে তা মানব শরীরে ঢুকে মুহূর্তে বিভাজিত হয়ে অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে ।

করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক না কৃত্রিম, তা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয় নি । আর এই বিতর্কে মিশে আছে রাজনীতি । চিন যেমন রাজনীতি করছে, তেমনি তার বিরুদ্ধবাদীরাও রাজনীতি করছে । শক্তিমানদের রাজনৈতিক খেলায় প্রাণ যাচ্ছে উলুখাগড়াদের ।এতদিন আমাদের পাড়ায় করোনার রব শোনা যায় নি । এবার গেল । আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে পূর্বাশা ফ্ল্যাট । একদিন দেখি পুরসভার লোক সে ফ্ল্যাট স্যানিটাইজ করছে । কী ব্যাপার ! জানা গেল নন্দীবাবু, তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর পুত্রবধূ করোনায় আক্রান্ত । আমরা জানতেই পারি নি । ফ্ল্যাটের এই সুবিধে । কোথায় কী হচ্ছে কাক-পক্ষীতে টের পাবে না । পৌরসভার এক কর্মী আমাকে বলেছিলেন, ‘ বস্তিগুলোতে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে । কেননা সেখানে আমরা যখন-তখন ঢুকতে পারি, সার্ভে করতে পারি, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারি । কিন্তু ফ্ল্যাটগুলোতে দরওয়ান আমাদের আটকে দেয় ।’ ঘোমটার ভিতর খ্যামটা নাচ চলে ফ্ল্যাটে ।
দুষ্টু আর স্মিতা সদ্য করোনা থেকে সুস্থ হয়েছে । বহুদিন তাদের সঙ্গে দেখা হয় নি । আমি আর আরতি ঠিক করলাম একদিন যাব মধ্যমগ্রাম । তাদের বাসায় যাব না, কারখানায় তাদের সঙ্গে দেখা করে বিকেলের দিকে চলে আসব । বেগরখালের গৌরীর স্বামী কৃষ্ণের ট্যাক্সি আছে । সে যেতে রাজি হল । মামনির যাবার ইচ্ছা ছিল । সন্দীপনের শরীর অসুস্থ হওয়ায় সে যেতে পারল না । মধ্যমগ্রামে মুক্তির হাওয়া বইছে । বাসে-অটোতে প্রচুর ভিড় । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘দো গজ দূরি / মাস্ক জরুরি’ মহামন্ত্রটি কেউ মানে না । দুষ্টু আর স্মিতাও কেয়ারলেস । তাদের মুখেও মাস্ক নেই । স্মিতাকে বলতে সে বলল, ‘আমাদের করোনা হয়ে গেছে । অ্যান্টিবডি তৈরি । কিচ্ছু হবে না ।’ এই জ্ঞানদা আমাদের পরামর্শ শুনবে কেন । দুষ্টুকে বলতে সে বলল, ‘ছাড় তো এসব । করোনা হয় হোক, ব্যবসাটা চালাতে হবে । গত কয়েক মাসে যে ক্ষতি হল তার কিছুটা মেক আপ না করলে মাঠে মারা যাব ।’ এই মনোভাব শুধু দুষ্টুর নয় । ছোট ও মাঝারি

ব্যবসায়ীদের । তারা মরিয়া হয়ে গেছে । জীবন ও জীবিকা এক মহাসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে । বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলছে করোনার জেরে সারা পৃথিবীর ১০ কোটি মানুষ ভয়াবহ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে । ছোট ও মাঝারি শিল্পে অনুদান প্রকল্প চালু করতে চলেছে জার্মানি । অন্যান্য দেশকেও এই পথ নিতে হবে । কিন্তু রাজনীতিওয়ালারা কী মানুষের কথা ভাবে ! তাদর যত চিন্তা ক্ষমতা দখল নিয়ে । এই করোনার আবহেও সেটা চলছে ।
সন্দীপনের নিম্নাঙ্গে ফাংগাল ইনফেকশন হয়েছে । তাই মামনি আর আর আরতি ডাঃ পরাগের কাছে গিয়েছিল । রোগীকে আনা সম্ভব নয় । তাই মোবাইলে ফটো তুলে এনেছিল । দিন দুই পরে ডাক্তারকে ফোন করতে শুনলাম তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন । ব্যস । আরতি আর মামনি অসুস্থ বোধ করতে লাগল । তারা কী সংক্রমিত হল ? কিন্তু না, চার-পাঁচ দিন কাটার পরে বোঝা গেল ঠাণ্ডা-গরমে শরীর খারাপ হয়েছিল । ডাঃ পরাগকেও পাব না । তিনি নার্সিং হোমে । অচেনা ডাক্তারকে দেখালে তিনি প্রথমেই করোনা টেস্ট করাতে বলবেন । টেস্টটা ঠিকঠিক হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে । বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যে সব টেস্ট হচ্ছে, তার বেশিরভাগ ভুয়ো । মনে আছে দুলালের কথা । তার কিডনির সমস্যা আছে । ডায়ালিসিস করাতে হয় । মিষ্টু তাকে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেল ডায়ালিসিসের জন্য । তাঁরা আগে করোনা টেস্ট করলেন, পরে ডা্য়ালিসিস করবেন । জানালেন দুলাল করোনা পজিটিভ । দুলালকে ৪০ হাজার টাকার প্যাকেজে ভর্তি করে নিতে চান । মিষ্টুর সন্দেহ হল । সে দুলালকে নিয়ে চলে এল এক সরকারি কোভিদ হাসপাতালে । পরীক্ষা হল । নেগেটিভ ।

এইসব দেখেশুনে সাধারণ মানুষ হতবুদ্ধি । তারা তাকিয়ে আছে প্রতিষেধকের দিকে । কবে টিকা আসবে বাজারে । টিকার দেখা নেই, কিন্তু তা নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে । আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান তারই লাগি তাড়াতাড়ি । কে আগে বের করবে টিকা ! আমেরিকা না রাশিয়া না চিন ! টিকার গণপ্রয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে রাশিয়া । দেশজ ভ্যাকসিন ব্যবহারে ছাড়পত্র দিয়েছে চিন । ভারতে টিকা তৈরি হবে ডিসেম্বরে । কোন কোন দেশ টিকা পাওয়ার জন্য এক বা একাধিক উৎপাদন সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলছে । যেমন রাশিয়ার স্পুটনিক ভি পেতে আগ্রহী কুড়িটি দেশ । অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকা ফের ট্রায়াল শুরু করেছে । কিন্তু টিকা বেরিয়ে গেলেই ল্যাঠা চুকবে না, তারপরে প্রশ্ন আসবে ডোজের । এক ডোজ কী যথেষ্ট ? তা যদি না হয়, তাহলে অনুন্নত দেশ বঞ্চিত হবে ।কোভিদ সংক্রমণ রুখতে প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ না করে হিউম্যান চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল দরকার বলে মনে করেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড জন রবার্টস । এতে সুস্থ মানুষের শরীরে ইচ্ছাকৃতভাবে প্যাথোজেন প্রবেশ করিয়ে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় ।

আমি জানি মানুষের এইসব কাজ-কারবার দেখে করোনাভাইরাস মুখ টিপে হাসছে । মনে মনে বলছে, ‘ওরে মানুষের বাচ্চা, খোদার উপর খোদকারি করার বড় সাধ তোর । এতদিন করেও গেছিস সেসব । প্রকৃতি জয়ের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে গেছিস । আমার জ্যাঠাতুতো, পিসতুতো, মাসতুতো ভাইরা, মানে সার্স-মার্স-স্মল পক্স-ইবোলারা তোদের সতর্ক করেছিল । কানে তুলিস নি সে সতর্কতা।তারাই আমাকে বলল তোদের উচিত শিক্ষা দিতে । তোদেরই হাওয়াই জাহাজে চেপে আমি চিন থেকে ইতালি, ইতালি থেকে ফ্রান্স, ফ্রান্স থেকে স্পেন, স্পেন থেকে আমেরিকা,সেখান থেকে লাতিন আমেরিকা ঘুরে বেড়ালাম । পা রাখলাম এশিয়ায়, আফ্রিকায়।তোরা দেখতে পেলি না, তোরা বুঝতে পারলি না । তারপর বুঝলি বটে, কিন্তু কিসসু করতে পারলি না।আরও অনেকদিন তোদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাব । দ্যাখ, কেমন মজা !

(লেখক: কলকাতার অধিবাসী, সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ও লেখক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)

 

 

You might also like