গোপন সীমানা
শামীম আহমদ তালুকদার
(পর্ব-২)
ইমারা শেখ তাছি নামে ভবনটির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্লাটে উঠেছিলাম। ভবনটির মালিক আল-মান্ডাক এলাকার (উম্দা) চেয়ারম্যান শেখ তাছি। রুমে প্রবেশ করে নিকট আত্মীয় ও অন্যান্যদের সঙ্গে ঘটনার বিস্তারিত বলেছি। সবাই গভীর মনযোগ দিয়ে শুনেছেন।কারো কোন মন্তব্য ছিলনা। রাত অনেক হয়েছে। খাবার সেরে সবাই নিজ নিজ বিছানায়।বালিশে মাথা রেখে এপাশ-অপাশ করছি। কিছুতেই চোখে ঘুম আসছিলনা।আনমনে ভাবছিলাম প্রতিটি মানূষ জীবনে একবার হলেও হয়তো প্রেমে পড়ে। কিন্ত সত্যি প্রেমের অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করেনি। মনের সাথে অপর একটি মনের বিন্দুর মিলন ঘটেনি।কারও প্রতি যৌন আকর্ষন ও আবেগীয় আকর্ষন আনন্দঘন অনুভূতি প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি।
এ কথা সত্য যে প্রেম ভালবাসা ছাড়া মানুষ অসম্পূর্ণ। আমাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে আমার মাতৃভূমি, জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রেম। মরুভূমির প্রখর রুদ্রে গম কাটতে গিয়ে আর ভেড়ার পাল ছড়াতে ছড়াতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি শিহরিত করেছে।এমন দেশটি আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্ম ভূমি।
আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে যুক্তরাজ্যের তিলোত্তমা শহর লন্ডন।লন্ডন সবার কাছে এক স্বপ্নের নগরী। আর আমার কাছে বেশি প্রিয় কারন এই তিলোত্তমা লন্ডন শহরে থাকেন আমার স্বপ্নের রাজকুমারী।যাকে দেখেনি যার সাথে কথা বলা হয়নি তার সাথে প্রেম অবিশ্বাস্য নয় হাস্যকর বটে। এছাড়াও যুক্তরাজ্যে বেড়ে উঠা একটি মেয়ে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ছেলেকে কী গ্রহন করবে। রাজকুমারীর একটা ছবি ছিল। ছবিতে অসাধারন এক হাঁসি। চেহারাটা নিষ্পাপ মাসুম মনে হয়েছে। কল্পনায় কত ছবি অংকন করেছি।
কিন্ত স্বপ্ন আর বাস্তবতা এক নয়। স্বপ্ন হলো সেটা যে স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায় দেখা হয়। তবে এটা কি সম্ভব মরুভূমির রাখাল বালক এক সময় তিলোত্তমা শহর লন্ডন পৌছে প্রিয়তমার দিদার লাভ করতে সক্ষম হবে। আমার কাছে মনে হয় একতরফা ভালাবাসা বা প্রেম হচ্ছে সবচেয়ে দামী। এর শক্তিই অন্যরকম। কারো প্রতি নির্ভরশীল হতে হয়না। কোন কিছু হারানোর ভয়ও থাকেনা। যদিও একতরফা ভালবাসার কোন ভবিষৎ নেই।ইসলামে নারী পুরুষের সম্পর্কের বৈধ পন্থা হলো বিয়ে। বিয়ের আগে নারী পুরুষের সম্পর্ক প্রেম ভালবাসা হারাম। যাক আমিতো কল্পনায় ভালবেসেছি। সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আল্লাহ ক্ষমাশীল। এই ভাবনার মাঝে মোয়াজ্জিনের কন্ঠে ফজরের নামাজের আযান ধবনি শুনতে পাই। রুমের সবাই ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করলেন। অত:পর সকালের নাস্তা খেয়ে কাজে চলে গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিছুক্ষন পর দরজায় জোরে জোরে ধাক্ষা আর হাক ডাক শুনতে পেলাম। কন্ঠ শুনে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি এইটা আমার (কফিল) বস আব্দুর রহমান। তার কন্ঠ একেবারে ভারতের অভিনেতা অমরিশ পুরির মত। অনেকটা ভয় পেয়েছি। ভাবছি দরজা খোলব নাকি খোলবনা। গম কাটতে গিয়ে অজগর সাপের মত দেখতে একটি সাপ দা দিয়ে এক কুপে শেষ করে দিয়েছে। কি সাহশ আব্দুর রহমানের। দরজা ভেঙ্গে ফেলার মত অবস্থা। তার সাথে কথা কিভাবে বলব।
আারবি ভাষা আমার জানা নেই। এছাড়া আমি আঘাত প্রাপ্ত হলে পাল্টা আঘাত করে জেলে যেতে চাইনা। কারন আমাকে স্বপ্নের নগরী তিলোত্তমা লন্ডনে যেতে হবে।কর্মজীবনে মাতৃভূমি ছেড়ে অনেকেই প্রবাসী হন। উদ্দেশ্য পরিবারের সদস্যদের মুখে হাঁসি ফোটানো। এই অল্প দিনে আরবিয়ানদের হাতে বেশ কিছু স্বদেশি ভাইদের নির্যাতিত হতে দেখেছি। অনেকটা কান্না পেয়েছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছে। ততক্ষনে আমার নিকট আত্মীয়ের ডাক শুনতে পেলাম। কিছুটা সাহসী ও আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠলাম। দরজা খুলে দেখি আমার নিকট আত্মীয় ও বসের মধ্যে তুমুল বাক যুদ্ধে চলছে। দীর্ঘক্ষন বাকযুদ্ধ শেষে আব্দুর রহমান মাআস্সালামা বলে চলে গেলেন। নিকট আত্মীয় জানালেন বস বলেছেন (মাজরা) কৃষিকাজ না করলে (করুজ নিহায়ি) ভিসা বাতিল করে দেশে পাঠিয়ে দিবেন। আর (ফ্রি ভিসা) মুক্তভাবে কাজ করতে হলে প্রতি মাসে পাঁচ শত রিয়াল বস্কে দিতে হবে। তিনি আমাকে বিনয়ের সাথে কথাগুলো বললেন। নিকট আত্মীয় আরো বললেন ভিসার শর্তমত যেহেতু কাজ হয়নি সেহেতু আমি দেশে ফিরলেও তিনি টাকা ফেরত দিয়ে দিবেন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে নিজেকে অনেকটা শক্ত করে সিন্ধান্ত নিলাম মাসে পাঁচশত রিয়াল (তৎসময়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা) দিয়ে হলেও থাকব।
এবার কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। আরবি ভাষা জানা না থাকার কারনে ভাল কাজ পাওয়া যাচ্ছেনা। বেশ খোঁজাখুজির পর বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি (বাগালা) মুদি দোকানে সাড়ে ছয়শত রিয়াল বেতনে চাকরি নিলাম। শাক, সবজি, মাছ, মাংসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সব কিছুই ছিল এই দোকানে।চাকরির এক মাস শেষ হওয়া পরদিন বস্ দোকানে হাজির। নতুন বস্রে অনুমতি সাপেক্ষে পাঁচশত রিয়াল দিয়ে দিলাম। এভাবে বেশ কয়েকমাস চলতে থাকে। সাড়ে ছয়শত রিয়াল বেতন পাই। কফিলকে পাঁচশত রিয়াল আর খাওয়া দাওয়া ও রুম ভাড়া আসে প্রতি মাসে সাড়ে তিনশত রিয়াল। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে আমি দুইশত রিয়াল দেনা হই। কি যে এক মহা বিপদ। দেশে টাকা পাঠাবো এটাতো কল্পনাও করতে পারছিনা। হঠাৎ একদিন বস্ এসে জানালেন এক সপ্তাহের মধ্যে (তানাজুল) ভিসা ট্রান্সফার না করলে (কুরুজ নেহায়ি) ভিসা বাতিল করে দেশে পাঠিয়ে দিবেন। এ যেনো মরার উপর খরার ঘা। এক সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি দোকানে এসে হাজির। তিনি জানতে চাইলেন নতুন (কফিল) পেয়েছি কিনা। আমি জবাবে বলেছিলাম, সুপার মার্কেট মাহাত্তা আল-খলব্ এর মালিকের সঙ্গে কথা চলছে। আর কিছু না বলে তিনি গাড়ী ড্রাইব করে চলে গেলেন। পরদিন সুপার মার্কেট মাহাত্তা আল-খলব্ এর মালিক আব্দুল্লাহ আলি বাদশা আমাকে ফোন করে জানালেন আব্দুর রহমান আমার পাসপোর্ট (একামা) পরিচয়পত্র তার কাছে দিয়ে গেছেন। অথচ আব্দুল্লাহ আলি বাদশার
সাথে বেতন নিয়ে চুড়ান্ত ভাবে কথা বলা হয়নি। যাক অন্য কোন উপান্তর না পেয়ে বাংলাদেশি দোকান থেকে বিদায় নিয়ে সুপার মার্কেট মাহাত্তা আল-খলব্ এ নয়শত রিয়াল বেতনে কাজ শুরু করলাম। সুপার মার্কেটে কিছু দিন কাজ করার পর (মাহাত্তা) পেট্রল পাম্পে লোকবল সংকটের কারনে আমাকে কয়েকদিনের জন্য কাজ করতে বলেন আব্দুল্লাহ আলি বাদশা। ঠিক পেট্রলপাম্পে কাজ শুরু করলাম। পেট্রল ও ডিজেল দেওয়ার জন্য ৬ টি যন্ত্র রয়েছে। কাজ করেছি আমরা দু’জন। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সন্ধ্যার পর টাকা গুণে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় প্রতিদিনই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ রিয়ালের কমতি পড়ে যেতো। পেট্রল বা ডিজেল দিয়ে দু’জনেই টাকা নিতাম। সন্ধ্যায় মিটার দেখে হিসাব কষে টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। আমার সঙ্গে যিনি কাজ করতেন তিনি অত্যন্ত কৌশলে এই অপকর্মটি করে থাকতেন। কিন্ত কেন ? তার সাথে আমার শত্রুতা কিসের থাকতে পারে ? ইতিমধ্যে একমাসের বেতন ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ বিষটি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছিলাম। চাকরি ও প্রবাসে থাকতে হলে এই ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।সব চেয়ে বড় বিষয় নিজের সততা মারাত্বক ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে। এই রহস্য উদঘাটন করা খুবই জরুরী। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবতো ? (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী