গোপন সীমানা
শামীম আহমদ তালুকদার:পর্ব-৬
প্রিয়সীর স্মৃতি হৃদয়ে ধারন করে কাঁদছি। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেই কাঁদব। যে আমাকে তার প্রয়োজন মনে করেনি তার স্বপ্নেই আমি কাঁদছি। যার চরণ তলে আশ্রয় পাইনি তাকে আমার চোখের পলকে বসিয়ে কাঁদছি। প্রিয় মানুষটিকে এক পলক দেখা ও আপন করে নেওয়ার বাসনায় লাখো মানুষের ভিড়েও নিঃসঙ্গ পথ চলা শিখেছি। পথ চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এখন সুন্দরতম এই পৃথিবীকে মাঝে মাঝে মিথ্যাবাদি মনে হয়। আনন্দ বেদনার অনুভূতি হীন একটা সময়। একটা পুরাতন ক্ষত নিরাময়ের জন্য নতুন একটা ক্ষতকে ঔষধের মত মনে হচ্ছে। প্রিয়সীর প্রেমে ক্ষত বিক্ষত এ হৃদয়। যতটা কষ্ট পেয়েছি হিসাব করে শেষ করা যাবেনা। তার পরও কাবা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে দুহাত তুলে প্রিয় ইবানা রহমানের জন্য মঙ্গল-ই কামনা করেছি।
সাড়ে ছয়শত রিয়াল বেতনে যখন কাজ করেছি তখনও আধলা পয়সা (হালালা) দিয়ে টেলিফোন বুথে গিয়ে লন্ডনে কথা বলতাম। একশত রিয়ালের আধলা (হালালা) সঙ্গে নিয়ে যেতাম। বেশির ভাগ সময় ইবানা রহমানের বাবা ফোন রিসিব করে থাকেন। ইবানার বাবা আমাকে খুব ¯েœহ করেন। তিনি রিসিব করার পর বলতেন রেখে দাও আমি ফিরতি কল করছি বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন দিতেন। সেদিন আর ইবানা রহমানের সাথে কথা বলা হতনা। আমি বেশি বেশি ফোন করতাম এই আশায় যে ইবানা রিসিব করলে তার সাথে কথা বলা যাবে। ইবানা ফোন রিসিব করলে একশত রিয়ালের আধলা (হালালা) শেষ করেই ফোন রাখতাম। এই ভাবে দুই তিন বছর কথা বলেছি। এর পর থেকে আর ইবানা ফোন রিসিব করেনি। এখন ফোন করা মাত্রই ইবানার মা রিসিব করেন। একদিন সাহস করে বলে ফেলি আন্টি ইবানার কাছে দেওয়া যাবে ? ইংলিশ দেশের মানুষের সাথে কথা বলছি তাই একটু স্টাইল করে আন্টি বললাম। আর কিছুটা বুঝাতে চাইলাম আমিও মডার্ন। কিন্ত তিনি একটু আমতা আমতা করে জবাব দিলেন উপরে। উপরে মানে ? দ্বিতীয় তলায়। সাহস আর করে বলতে পারিনি একটু ডেকে দেন। এর পর যতবার ফোন করেছি আান্টি রিসিব করতেন। তিনি হয়ত অনুমান করতে পেরেছিলেন কোন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তাই দুরত্ব ও বাঁধার দেয়াল তৈরি করে দিলেন। আমার মনের মধ্যে একটা শংষ্কা কাজ করছিল হয়তো ইবানার বিয়ে হয়ে গেছে। আবার ভাবছি সেদেশে যে আইন কানুন শুনেছি আটার বছরের আগে বিয়ে হবেনা। ইবানার আটার বছর পূর্ন হবে নয় মাস পর। কিন্ত আমি নাছোড় বান্দা। এই সময়ের ভিতরেই আমাকে লন্ডন পৌছাতে হবে।
ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা কিংবা নিয়ম-নীতি আছে আমার জানা নেই। ভালোবাসা এমন একটি অদৃশ্য ব্যাপার যা প্রতিটি মানুষের জীবনে কাক্সিক্ষত। ভালোবাসা বিহীন জীবন মরুভূমিতে নিঃসঙ্গ পথিকের ন্যায় একটু ভালোবাসা পাবার আশায় তৃষ্ণার্ত। হয়ত সব কিছুই ভাগ্যের খেলা। কিন্ত এই নিঃসঙ্গতায় নিঃসন্দেহে কারো না কারো হাত রয়েছে। হৃদয়ের গহীনে অনুভবহীন কষ্ট আর কষ্ট। মন যখন কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে তখন ভালবাসার মানুষ দেখতে পায়না। একজন প্রেমিক ধবংস হয়ে যায়। তবুও প্রিয়সীর মুখে সেই অমর বাণী শুনতে হয়। এভাবে প্রেম হয়না। তখন মনে হয় কষ্টগুলোর সাথে পুরাতন সম্পর্ক ছিল। কাউকে আপন বলতে পারার বিশ^াস যোগ্যতা হারিয়ে ফেলি। প্রিয় মানুষের দেওয়া কষ্ট একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মোনাজাতে দুহাত তুলে তার সকল দুঃখগুলিইতো আমি-ই চেয়ে নিয়েছিলাম। মুখোশ উম্মোচন করে মানুষের আসল চেহারা দেখানোর জন্য কষ্টকর এই সময়টার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়।
এভাবে কেটে গিয়েছে প্রবাস জীবনের এক যুগ। নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্টানের কাজ শেষ হলো। কিন্ত শেষ হিসাব কষে আমার হাতে বাঁচল সাড়ে তিন হাজার রিয়াল। কফিল (বস)’র আরেকটি বহুতল ভবন নির্মানাধীন। আব্দুল সালে তুরমানি জানিয়েছেন পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে কাজ ধরতে হবে। আমি ছয় মাসের ছুটি চেয়ে নিলাম। তিনি বললেন এর ভিতরে যদি অন্যান্য কাজ শেষ হয় তিনি ফোন করে জানাবেন। যেন নিদ্রষ্ট সময়ে ফিরে আসি। মনে মনে ভাবছিলাম এক যুগ কাটিয়ে সাড়ে তিন হাজার রিয়াল উপার্জন করেছি। স্বেচ্ছাশ্রমে আপনার ভবনগুলোর কাজ করে দিতে অবশ্যই আসবো। তবে আগে পার্সপোর্ট হাতে দাও। আসা যাওয়া চলতেই থাকবে। কয়েকদিনের মধ্যে টিকেট করে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে ফিরে বাবার ব্যাবসা প্রতিষ্টান দেখা শুনা করতাম। কিন্ত মন কিছুতেই বসছেনা।
ইবানা রহমানের লাল পাসপোর্ট। তাই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে তাকে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশিদের সংখ্যাও ছিল একাধিক। প্রবাসে থাকাকালিন সময়ে সৌদিরআরব থেকে দালালের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য পাড়ি দেন আমার আতœীয় আবু সালেহিন। কিন্ত হিথ্রো ইয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে তাকে আটক করা হয়। তার বিষয়টি শেষ পর্য়ন্ত এমন অবস্থায় গিয়েছিল যে বিয়ে ছাড়া সেদেশে থাকার বিকল্প কোন উপায় ছিলনা। পরে আবু সালেহিনকে তার এক চাচাত ভাই জামিন হয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। আবু সালেহিন আমার একবারে রক্তের আত্মীয়। আটক অবস্থা থেকে মুক্তির পর তিনি আমাকে ফোন করে তার বিস্তারিত বলেন। বৈধ ভাবে থাকতে হলে বিয়ে করতে হবে। েেসদেশ আত্মীয় ছাড়া বিয়ে করা অনেক কঠিন। তিনি ইবানা রহমানকে বিয়ে করতে চান। আর এ বিষয়ে আমার আব্বা যদি ইবানা রহমানের আব্বাকে বলেন তবে এই বিয়েটা হয়ে যাবে। আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম ঠিক আছে আব্বাকে বলব তিনি যেন ইবানা রহমানের বাবাকে এই কথা বলেন। ইবানা রহমানের প্রতি অধিকার প্রশ্নে আমরা দুজনেরই সমান। এক যুগের অধিক সময় ধরে মুরুভূমিতে ছাগল ছড়ানো আর খালাসি শ্রমিকের কাজ করে জীবনে শ^াস রুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজমান। আমি জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে কাবা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে একটি কথা বলেছিলাম। হে! আল্লাহ, ইবানা রহমান যদি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার জন্য কল্যানকর হয় জীবন সাথী হিসাবে কবুল করে নাও। জীবনে একবার হলেও স্বপ্ন নগরী লন্ডনে নিও। আমার একটা বিশ^াস ছিল যে, যার ভাগ্যে ইবানা রহমান তার হাতেই যাবে। শেষ পর্য়ন্ত আবু সালেহিন এর সঙ্গে ইবানা রহামনের বিয়ে হয়নি। তিনি তার চাচাত বোনকে বিয়ে করেন। সেটেলমেন্ট ভিসায় আবু সালেহিন বৈধবাবে বসবাস করছেন যুক্তরাজ্যে।
আমাকে স্পন্সর করার জন্য আবু সালেহিনকে অনুরোধ করি। তিনি সদয় হয়ে তার এক মেয়ে বন্দুকে দিয়ে আমার জন্য স্পন্সর বা ইনবাইটেশন লেটার পাঠান। আমার ব্যাংক ব্যালেন্স পর্যন্ত দিয়ে তিনি আমাকে আজীবনের জন্য কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন। সব কিছু প্রসেস করে ভিসার জন্য আবেদন করি। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে রিফিউজ করে দেওয়া হলো। কারন হিসাবে বলা হয়, আপনি ব্যাবসা করেন দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কিন্ত ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছেন চলতি বছরের। তাই আমি নিশ্চিত হতে পারিনি আপনি একজন প্রকৃত ব্যাবসায়ী। আপনি যুক্তরাজ্যে গিয়ে ফিরে আসবেন সে বিষয়টিও আমি নিশ্চিত না। এবং আ্যপিল করারও পূর্ণ অধিকার নেই আপনার।
তার পর আবু সালেহিন এর সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানাই। অ্যাপিল করার পূর্ণ অধিকার না দেওয়ায় খুব শংষ্কার মধ্যে ছিলাম। তিনি সেখানে রিভিউ করার জন্য আবেদন করেন। রিভিউ করার পর অ্যাপিলের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়। তখন তিনি অ্যাপিল করেন। আমি দেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র পাঠিয়ে দেই। শুনানির দিন তিনি ও তার বন্ধু কোর্টে যান। যুক্তরাজ্য গিয়ে আমি ফিরে আসবো কোর্টকে আশ^স্থ করেন। কোর্ট আবেদন গ্রহন করে ভিসা প্রদানের নির্দশ প্রদান করেন। এর কয়েকদিন পাসপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ফোন করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ, পার্সপোট জমা দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ভিসা পেলাম। সপ্তাহ খানেক পর বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হিথ্রো ইয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট চেক করতে এত সময় নিয়েছিলেন যে রীতিমত ভয় পেয়েছিলাম। ঘন্টাখানেক পর পার্সপোর্টে সিল দিয়ে বলেছিলেন ডউন্ট স্টে। ভেতর থেকে বের হলাম। রিসিব করলেন আবু সালেহিন। নিজে ড্রাইব করে নিয়ে গেলেন ইস্ট লন্ডনের একটি ঘরে। সেদেশে বাসার পরিবর্তে ঘর শব্দটি প্রচলিত। তবে যার জন্য এই স্বপ্ন নগরীতে আসা তার ঘর কতদুর। প্রিয়সীকে দেখার তীব্র আকুতি ভয়ষ্কর হয়ে উঠেছে। এই পৃথিবী যদি কাগজ হয়ে যায় আর সাগরের জল যদি কালি হয়ে যায় তুবুও অনুভূতি প্রকাশের জন্য কম হবে। লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী