জীবনের শেষ ওয়েটিং রুম
সাঈম চৌধুরী
সেন্ট জোসেফ হসপিস থেকে ফোন করলেন তিনি। কন্ঠস্বর বেশ অস্পষ্ট। পরিচয় দেবার পরও তাই পরিচয় বুঝে নিতে একটু সময় লাগে।
তিনি দিনার আহমেদ। তাঁর সাথে আমার বেশ দূরবর্তী সম্পর্ক। যুক্তরাজ্যে আসার পর প্রথম কিছুদিন এক সাথে কাজ করেছি। সেও পনেরো বছর আগের কথা। সম্পর্কের খাতা বহু আগেই বন্ধ হয়েছে। হসপিস থেকে ফোন করে সেই বন্ধ খাতা আবার খোলেন দিনার আহমেদ।
যখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল তখন মোবাইল ফোন থাকলেও এখনকার মতো এতোটা ডিজিটাল হয়ে যায় নি মানুষ। সেই সময়ে ফোন নম্বর লিখে রাখার জন্য আলাদা ফোনবুক বা ডায়েরি ব্যবহার করতেন অনেকে। দিনার আহমেদও এভাবে আমার নম্বর টুকে রেখেছিলেন, আজ ডায়েরি খুলে সেই নম্বরে ডায়াল করেন তিনি।
পুরাতন সময়ের চেনা কারো ফোন এলে, সেটি তখন আর কেবল ফোনালাপ থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে টাইম মেশিনে ভ্রমণ, স্মৃতির অলিগলি ধরে হাঁটাহাঁটি।
মনে পড়ে, দিনাজপুরে বাড়ি ছিলো দিনার আহমেদের। আমরা ডাকতাম, দিনাজপুরের দিনার ভাই। ছোটখাটো মানুষ, ছিমছাম জীবন। বেশ গুছিয়ে কথা বলতেন । খুশি হলে শরীর দুলিয়ে হাসতেন। রাগ করলে চেহারায় সেটি লুকানোর উপায় জানতেন না।
সেই দিনাজপুরের দিনার ভাই যিনি এককালে কেবল কথা দিয়ে আশপাশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন আর আজ তিনি মাত্র দু’তিনটে বাক্য বলে হাঁপিয়ে ওঠেন। গলা যেনো ভেঙে আসে তাঁর। কাতর স্বরে বলেন, প্লীজ একবার আমার সাথে দেখা করেন। জরুরি দরকার।
বাংলাদেশে ডাক্তার শেষ জবাব দেয়ার পর স্বজনরা রোগীকে আর হাসপাতালে রাখতে চান না। বাড়িতে নিয়ে যান। যেনো সে জীবনের শেষ সময় চেনা বাড়ির চেনা পরিবেশে কাটাতে পারে। যেনো তাকে মমতায় ঘিরে রাখে চেনা চেনা প্রিয় মুখ। যেনো তাকে ছায়া দেয় তার নিজ হাতে লাগানো সেই চেনা গাছ। এ সময় রোগীকে সাধ্যমতো ভালো খাবার খেতে দেয়া হয়। পরিবারের সবচেয়ে দূরে থাকা মানুষটিও কাছে থাকার চেষ্টা করেন। এইসব কিছু করা হয় জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির অন্তিম সময়কে যতটা সম্ভব স্বস্তিময় করে তুলতে। সব ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়ার মতো কঠিন নিষ্ঠুর ব্যাপারটাকে সহনীয় করে তুলতে।
বাংলাদেশে যে প্রচেষ্টা করা হয় ঘরের ভেতরে, বিলেত আমেরিকায় সেই ব্যাপারটা ঘটে হসপিসে।
সচরাচর যাদের জীবনের আয়ূ বড়জোড় ছয় থেকে বারো মাস, বেঁচে থাকার আশা খুবই ক্ষ্রীয়মান, যারা আক্ষরিক অর্থেই চিকিৎসার উর্ধ্বে, কেবলমাত্র তাদের জন্যে খোলা থাকে হসপিসের দরজা।
হসপিসে যে যায়, সে আর ফিরে আসে না। হসপিস মানে মৃত্যুর অপেক্ষার থাকা জীবনের শেষ ওয়েটিং রুম।
হসপিসে হাসপাতালের মতো রোগ নির্ণয়ের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা নেই। রোগীকে সারিয়ে তোলার, বাঁচিয়ে রাখাই তোড়জোড় নেই। সুস্থতার, সবলতার আশাও নেই।
হসপিস মেডিকেলের এমন শাখা যেখানে শান্ত সৌম্যভাবে কেবলমাত্র মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করা হয়। ধরা যাক, একজন ক্যান্সার রোগীকে হসপিসে পাঠানো হলো। তার মানে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার জাগতিক আয়োজন শেষ। তাঁর জন্য বন্ধ কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির দীর্ঘ ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। এখন থেকে তার মৃত্যুর পথকে আর দীর্ঘায়িত করা হবে না । খেতে পারলে খাবেন, না পারলে নেই। মুখে নল ঢুকিয়ে কৃত্রিম উপায়ে খাওনোর চেষ্টা করা হবে না। ভেন্টিলেটর, সার্জারি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল হিসাব নিকাশ হসপিসে নেই। এখানে হিসাব সোজাসাপ্টা।
রোগীর যদি ঘুম আসে না, হয়তো তাকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হবে, যদি তার তীব্র ব্যথা থাকে তবে ব্যথানাশক দেয়া হবে। এতটুকুই। এর বেশি কিছু নয়।
হসপিস মৃত্যুকে দ্রুত করে তুলে না বরং মৃত্যুর পূর্বের সময়টুকুকে তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক করার চেষ্টা করে, কষ্টকে যথাসাধ্য সহনীয়, কোমল করে তোলার চেষ্টা করে।
মৃত্যুর সঙ্গে স্রষ্টার সম্পর্ক গভীরতর। মৃত্যু নিশ্চিত জানলে মানুষ অধিক স্রষ্টামুখী হয়। এ কারণে হসপিসে যার যার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী আধ্যাত্মিক সহায়তাও পাওয়া যায়।
পরম করুনাময়ের ডাকের অপেক্ষায় হসপিসের বেডে শুয়ে থাকা মানুষটির কাছে এসে হাজির হন হয়তো চার্চের ফাদার, নয়তো মন্দিরের পুরোহিত অথবা মসজিদের ইমাম সাহেব। পাঠ করে শোনান পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। বলেন, মৃত্যু মানে পরম করুণাময়ের আরো নিকটবর্তী হওয়া। যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে ঝর্ণাধারায় বহুমুখী প্রবাহ। যেখানে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে প্রবেশ করবেন আর সে স্থান থেকে কখনোই তাকে বিতাড়িত করা হবে না’।
এভাবে সাহস জুগিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয়। বস্তুত হসপিসে ভর্তি হওয়া মানুষের জীবনে মৃত্যু ছাড়া দ্বিতীয় কোনো গন্তব্য নেই, গত্যন্তরও নেই।
সেই হসপিস থেকে দিনাজপুরের দিনার ভাইয়ের ফোন পেয়ে আমি বিচলিত হই। তাঁকে দেখার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়।
পূর্ব লন্ডনের মেয়ার স্ট্রিটের সেন্ট জোসেফ হসপিস
আমার বাসা থেকে বেশি দূরে না। এমনকি চাইলে দিনে সাতবারও যাওয়া আসা করা যায়!
কিন্তু এখন সময়টাই দুঃসময়ের দখলে। করোনা মহামারি যাপিত জীবনের সব প্রয়োজন, তাবৎ যোগাযোগকে নতুন নিয়ম দিয়েছে।
এমনিতে অবশ্য হসপিসে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতে বাঁধাধরা নিয়ম নেই। হসপিসের দরজা স্বজনের জন্য সব সময় খোলা। তবে এখন সে পরিস্থিতি নেই। কেবলমাত্র দুইজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যথা নিয়ম অনুসরণ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখা করতে পারবেন।
সে অর্থে দিনার আহমেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের তেমন সুযোগ নেই। তবুও হসপিসের রিসেপশনে ফোন করি। রিসিপশনের মেয়েটি একটু অবাক হয়। বলে, মিস্টার আহমেদের কোনো বন্ধু কিংবা স্বজন আছে বলে তো জানি না। তিন মাসে একদিনও কেউ তাকে ফোনই করে নি, দেখতে আসা তো বহু দূর।
মেয়েটি সহজেই দেখা করার অনুমতি দিয়ে হসপিসে দেখা করার নিয়ম-কানুন জানিয়ে দেয়।
পরদিন জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো হসপিসে যাই। পরপারে যাত্রার অপেক্ষায় হসপিস নামের এই ওয়েটিং রুমের আর কোনো যাত্রীর সাথে এদিন দেখা হয় না। কেবল দেখা হয় আমাদের দিনাজপুরের দিনার ভাইয়ের সাথে। দেখে তাকে চেনার উপায় নেই। যেনো বাংলা ভাষার অস্থিচর্মসার শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ। জীবনের সময় ফুরিয়ে এলে একে একে ছুটি নেয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো। জানতে পারি, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। দ্রুত কমছে হাঁটার শক্তি, হাতের ভর, গলার আওয়াজ।
দিনাজপুরের দিনার ভাই তার যৌবনকালে একদিন ইরান, তুরস্ক, ফ্রান্স হয়ে লরির পেছনে চেপে কার্লে বর্ডার দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। এদেশে বৈধ অভিবাসী ছিলেন না তিনি। তাই সেই যে বিশ বাইশ বছর আগে এসেছিলেন তারপর আর ফেরা হয় নি দেশে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা আর বেঁচে নেই, মাও মারা গেছেন দুই বছর আগে। এদেশে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বনিবনা হয় নি। মৃত্যুর আগে পরিপূর্ণ একা মানুষ।
বছর তিনেক আগে এদেশে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া সেই তুমুল একা মানুষটি এ মাটিতে এবার স্থায়ী ঘুমের বন্দোবস্ত নিয়েছেন।
তাঁর আর কোনো পিছুটান নেই, পিছুডাকও নেই। তবে কেনো আমাকে ডেকে আনেন তিনি, কিসের আশায়, কী প্রয়োজনে?
উত্তরের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি দ্রুত কথা শেষ করে দিতে চান। বলেন, দিনাজপুরের লিচু খাইতে মন চায়। খাঁটি দিনাজপুরের খাঁটি মাটির লিচু, আনিয়ে দিতে পারবা?
বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতো ছেলেমানুষী আবদার। কিছু সময় নীরব থাকি। তার কাছ থেকে সময় চেয়ে নেবার মতো সময় কই! তবু বলি, লিচু আনিয়ে দিতে পারবো, তবে কয়েকদিন লাগবে।
আমার আশ্বাসে প্রায় গর্তে ঢুকে পড়া চোখে কিছুটা হলেও যেনো আশার ঝলক দেখি।
দিনার ভাইকে বলা হয়নি, দিনাজপুরের লিচু এখন আনা যাবে না কিছুতেই। করোনার কারণে দেশে আসা যাওয়া প্রায় বন্ধ। কেউ যদি আসে তাকে দশদিন থাকতে হয় হোটেল কোয়ারেন্টাইনে। এমন দুঃসময়ে কে আনে লিচুর গোছা!
চাইলে বাজার থেকে লিচু কিনে নিয়ে বলতে পারি, এই নিন দিনাজপুরের লিচু। এমন প্রতারণায় কোনো দোষ নেই। আমি তাও করি না।
দিনার ভাইকে কথা দিয়েছি, লিচু নিয়ে তার কাছে যাবো।
তিনি অপেক্ষায় আছেন। থাকুন। মৃত্যুর অপেক্ষার চেয়ে দিনাজপুরের লিচুর অপেক্ষা অনেক বেশি মার্জিত, অনেক বেশি কোমল।
সাঈম চৌধুরী: সাংবাদিক ও গল্পকার।