দিরাইয়ে বিরোধপূর্ণ জলমহাল নিয়ে আবারও উত্তেজনা

সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ জলমহাল নিয়ে বিরোধ, সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও আঞ্চলিক দাঙ্গা এই শব্দগুলোর সাথে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মানুষ। বিগত এক দশকে ত্রিপল মার্ডারসহ একাধিক প্রাণহানির ঘটনায় জলমহালকে কেন্দ্র করে ঘটেছে এই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিগত ২৫ বছরের অন্তত ৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায়।
এসব দাঙ্গার বেশিরভাগই ছিল খাসজমি, জলমহালের দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। ইউনিয়নের মধুরাপুর গ্রামের ইজারকৃত জলমহাল নিয়ে ফের উত্তেজনা বিরাজ করছে। চাতল দীঘা রমজানপুর জলমহালের ইজারদার ও গ্রামবাসীর দ্বন্ধ রূপ নিতে পারে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। যা এলাকার কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
দিরাই থেকে সংবাদদাতা জানান, চাতল দীঘা রমজানপুর বিল জলমহালটি জয়সিদ্ধি শান্তিপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ এর অনুকূলে ১৪৩০-১৪৩৫ বাংলা সন মেয়াদে উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় ইজারা প্রদান করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ইজারাদার কর্তৃক যথাসময়ে ইজারামূল্য পরিশোধ করে দখলপ্রাপ্ত হওয়ার পর জলমহালটি শাসনে স্থানীয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম মুরাদপুরের শ্রমিকদের জলমহালে নিযুক্ত করে মৎস্যজীবী সমিতি। এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মধুরাপুর গ্রামের একটি প্রভাবশালী চক্র। সরকারি জলমহাল গ্রামের সম্পদ বলে জলমহাল শাসনে ইজাদার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে বাঁধা প্রদানের অভিযোগ উঠে মধুরাপুর গ্রামের খোরশেদ মেম্বার, দিল হকসহ স্থানীয় পঞ্চায়েতের কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ইজাদার কর্তৃক বাঁশ-কাঁটা দিয়ে জলমহালে মৎস্য আশ্রয়স্থল তৈরি করলে এটি লুটপাট করে স্থানীয় দুর্বৃত্তচক্র। যার নেপথ্যে খুরশেদ গংদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইজারাদার সমিতি। জলমহাল লুটের বিষয়ে খুরশেদ ও দিলহকসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে একটি নন-জিআর মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। এদিকে জলমহাল ইজারাপ্রাপ্তির দীর্ঘদিন অতিবাহিত হতে চললেও স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের প্রভাবে জলমহাল ভোগদখল করতে পারছেন মৎস্যজীবী সমিতি সংশ্লিষ্টরা। এতে মধুরাপুর ও মুরাদপুরে গ্রামের মধ্যে জলমহালকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দাঙ্গার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সম্প্রতি সরেজমিনে চাতল দীঘা রমজানপুর জলমহালে গিয়ে দেয়া যায়, জলমহাল এলাকা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জলমহালে কোনো প্রকার বাঁশ-কাঁটা নেই। জলমহাল এলাকা লোকশূন্য অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় একাধিক হাঁসের খামারের আবাস্থল হয়ে উঠেছে জলমহালটি।
হাওরের একাধিক কৃষক ও স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জলমহাল নিয়ে ইজারাদার ও এলাকাবাসীর দ্বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
জলমহালটি জয়সিদ্ধি শান্তিপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ সংশ্লিষ্টরা জানান, উন্নয়ন স্কীমের আওতায় ৫ বছর মেয়াদে চাতল দীঘা রমজানপুর বিল জলমহালটি ইজারা নিয়ে আসলেও মধুরাপুর গ্রামের প্রভাবশালী চক্রের কারণে ভোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। একাধিকবার জলমহালে লুটপাট হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতগ্রস্ত হয়েছেন তারা। প্রভাবশালী চক্রের ভয়ে জলমহালে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রভাবশালী চক্রের প্রভাবে জলমহাল ভোগদখলে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি মো. কুদ্দুস মিয়া। আশঙ্কা প্রকাশ করে এই মৎস্যজীবী বলেন, আমি সরকারের ঘরে টাকা দিয়ে জলমহালটি এনেছি । জলমাল দেখভালের জন্য মুরাদপুর গ্রামের কিছু শ্রমিককে দায়িত্ব দিয়েছি। দিলহক ও খুরশেদ গংদের কারণে জলমহালে যেতে পারছিনা। প্রতিদিন জলমহালে মাছ ধরছে মধুরাপুর গ্রামের মানুষজন। আমার লোকেরা বাঁধা দিলে তাদের উপরন্ত হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট খামারিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে জলমহালটিকে হাঁসের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মুরাদপুর গ্রামের বাসিন্দা সাবাজ মিয়া ও রুশন মিয়া বলেন, বিল আনছে অন্যগ্রামের সমিতি। আমরাসহ আমাদের গ্রামের কিছু লোক শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। মধুরাপুর গ্রামের কিছু লোক স্থানীয়দের উস্কিয়ে দিয়ে জলমহাল লুট করেছে। প্রতিদিন মাছ ধরছে তারা। তারা জলমহালে আমাদের যেতে দিচ্ছে না।
মজু মিয়া নামের আরেকজন বলেন, মধুরাপুর গ্রামের আশেপাশে সরকারি কিছু খাস জমি ও জলমহাল রয়েছে। এই জলমহাল নিয়ে প্রতিবছর মারামারির সৃষ্টি হয়। এই মারামারিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এবারও এই জলমহাল নিয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেকোনো সময় বড় ধরণের দাঙ্গার সৃষ্টি হতে পারে। এতে এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় এই সচেতন নাগরিক।
এদিকে জলমহালে ভোগদখলে বাঁধা দেয়ার বিষয়টি মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অভিযুক্ত খুরশেদ আহমদ ও দিলহকসহ স্থানীয় একাধিক পঞ্চায়েতের ব্যক্তি। খুরশেদ আলম বলেন, জলমহাল ভোগ-দখলে আমাদের বাঁধা নেই। আমি বা আমরা কেউ কখনো জলমহালে যাইনি। অহেতুক মামলা দিয়ে আমাদের গ্রামের নিরীহ মানুষদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে দিরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জনি রায় বলেন, জলমহালটি জয়সিদ্ধি শান্তিপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ-এর অনূকুলে রয়েছে। জলমহালটি দখলে যাওয়ার সময় মধুরাপুর গ্রামের লোকজন বাঁধা দেয়। ইউএনও মহোদয়সহ স্থানীয় লোকজনের হস্তক্ষেপে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এরপরও মধুরাপুরের লোকজন ব্লক সৃষ্টি করে জলমহাল থেকে মাছ আহরণ করছিল। আমি নিজে মোবাইল কোর্ট করে একাধিক জনের বিরুদ্ধে জরিমানা করেছিলাম । বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নই। যেহেতু ইজারদার সরকারিভাবে জলমহাল ইজারা নিয়েছেন এতে কেউ বাঁধা দিলে এবং অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে ইউএনও মো. মাহমুদুর রহমান খোন্দকার-এর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।

You might also like