পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।-সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥বিশ॥
হঠাৎ দেখলাম আমি, সঙ্গী সাথী হারিয়ে ফেলেছি। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে পেলাম একমাত্র সুরাইয়া খালাকে। দুদিন ধরে আমি মিডিয়াদের বলে আসছি একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে বুড়িগঙ্গার ‘স্কাইক্লাব’এ একটি মানুষের সাথে। এই ঘটনায় আমি ব্যথিত, ক্ষুদ্ধ এবং প্রতিবাদী।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিক যারা এসেছেন, মুর্হতেই দেখতে পেলাম, এদের আচার আচরণ বদলে গেছে। আমি অভিযোগ দায়ের করছি, কিন্তু তারা উল্টো আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে। যেন আমি অপরাধী বা অপরাধ করে এসেছি। আমি বললাম, মামলা করবো। মামলা করতে থানায় গেছি, কিন্তু থানা আমার মামলা নিচ্ছে না। কেন নিচ্ছে না, তা আমি জানি না।
আমার বক্তব্য লিখে নিয়েছি। সাংবাদিকরা পড়তে দিচ্ছে না। পড়ার আগেই প্রশ্ন। আমি বললাম, আমার বক্তব্য পড়ে শুনাচ্ছি। এ সময় লম্বা মতন একজন ক্যামেরা উঁচিয়ে বললো, ম্যাডাম পড়ুন আপনারলেখা বক্তব্য।
আমি কান্না শুরু করে দিলাম। কান্না দেখে সুরাইয়া খালা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। শান্ত করলেন আমাকে।
আমি পড়তে শুরু করলাম। ‘আমি ‘স্কাই ক্লাবে’ মূলত যাইনি। আমার সঙ্গীয় আলতামাস স্কাইক্লাবের নিকট গিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। বললো, একটু কাজ আছে তার। সে গাড়ি থেকে নেমে, বললো, ম্যাডাম জায়গাটি সুন্দর। চলেন, দেখবেন নাকি? এ সময় সঙ্গে থাকা আমার খালাতে বোন সে বাথরুমে যাবে বললো। তার সঙ্গে আমিও নেমে যাই। সেখানে নেমে উপরে উঠি। দোতালায় বার। সেখানে বসিয়ে রেখে আলতামাস ভেতরে যায়। পাঁচ মিনিটের মত হবে, সঙ্গে আসেন জহির নামের লোক। লোকটি আমার আগের চেনা নয়। এসেই কুশল জিজ্ঞেস করে বললেন, চলুন ভেতরে। একটি বিশেষ রুমে নিয়ে গেলেন। আমি যেতে চাইনি। এ সময় আলতামাসও অনুরোধ করে। ভেতরে যাই। একটি সোফায় বসি। এতক্ষণে আমার খালাতো বোনও বাথরুম সেরে এসেছে। আমিও বাথরুমে যাই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর ঐ লোক, যিনি জহির বলে পরিচয় দিয়েছিলেন,তিনি আমার পাশে একটি মদের গ্লাস নিয়ে বসেন। আমি সরে বসি। তিনি আবার আমার পাশ চেপে বসেন। আগডুমবাগডুম কথা বলে তিনি আমাকে সহজ করতে চাইলেন। আমি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। তিনি আবার চাপলেন,আমার গা ঘেষে বসতে চাইলেন। আমি মৃদু প্রতিবাদ করি। তখনই লোকটি ক্ষেপে যায়। সে আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে হাতের থাকা মদের গ্লাস কাত করে আমার মুখে ঢেলে দিতে চেষ্টা করে। আমি মুখ খুলি না, ঠোঁট চেপে ধরি। যেই ঠোঁট চেপে ধরেছি, লোকটি মুখের ওপর ঢেলে দেয় মদ। আমি বিব্রত হয়ে ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিই। এতে গ্লাসটি ভেঙ্গে যায়। এরপর, আমার শরীর জড়িয়ে আলতুফালতু কথা বলতে থাকলে আমি উঠে যাই। আমার সঙ্গে থাকা আলতামাসের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আমি আরও বিচলিত হই। এ সময় আমার ড্রাইভার এসে পড়ে। সে কোন কিছু ঘটছে ভেবে তার মোবাইল দিয়ে রেকর্ড করে। আপনারা যে ফুটেজ আমার ফেইসবুকে দেখছেন, এটা তার তোলা ফুটেজ। তাকে তারা ঝাপটে ধরে। রেকর্ড করতে বাঁধা দেয়। আমার মোবাইল ঐ জহির নামের লোকটি কেড়ে নেয়।
এতো হেনস্থা করার অর্থ আমি বুঝতে পারি ঐ লোকটি জহির আমাকে রেফ করতে চেয়েছিল। তারপর, আমি এক ধরণের হুঁশ হারিয়ে ফেলি বা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমাকে আমার বোন ও ডাইভার ধরে নীচে নামিয়ে আনে। পরে গাড়িতে ওঠে স্থান ত্যাগ করি। কিন্তু আলতামাস আর আমাদের সাথে আসে না। আমার সন্দেহ হল, আলতামাস তাদের সাথে কোন যোগসাজস করে আমাকে এখানে নিয়ে আসে। আপনারা বলবেন, আলতামাসের কথায় কেন ঐখানে গেলাম। আলতামাসই বা কে?। আলতামাস আমার কস্টিউম বাহারের বন্ধু। সে বাহারের সাথে আমার বাসায় প্রায়ই আসতো। বেশ কিছুদিন ধরে সে আমার ঘনিষ্ট হয়েছে। আমি তাকে বিশ্বাস করতাম। এখন দেখছি এই বিশ্বাসটা ছিল ভুল।’
পড়া শেষ করার পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে মিডিয়াকর্মীরা। এরপর, কত প্রশ্নের জবাব দিলাম। অনেকে প্রশ্ন করলো, তিন কোটি টাকার গাড়ি কে দিল। উপহার, নাকি আমি কিনেছি, এতো টাকা পেলাম কোথা থেকে। আসলে আমার গাড়ির দাম বিশ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কিনেছি।
তারা একটি গাড়ির ছবি দেখিয়ে বললো, এটা আপনার গাড়ি না? আমি হেসে বললাম, না, এটা আমি শোরুম থেকে একদিনের জন্য ট্রায়ালে এনেছিলাম। পরদিন ফেরত দিয়েছি। আরেকজন প্রশ্ন করলো, আমার ফ্লাটের দাম কত? আমি অভিজাত ফ্লাট কত টাকায় কিনেছি। আমি বললাম, এটা কিনিনি, আমি ভাড়া থাকি। আমার টাকার পয়সার সোর্স নিয়ে বার বার প্রশ্ন করায় বললাম, আমার ইনকাম অনেক। আমি বছরে বিশ লাখ টাকা ইনকামট্যাক্স দিই। আমি এ পর্যন্ত কুড়িটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ। পাঁচটি মুক্তি পেয়েছে। ভাল মার্কেট পেয়েছে ছবিগুলো। একটি তো সুপার হিট করেছে। এখন আমি যে ছবিগুলোতে অভিনয় করছি, সেগুলো আলোচিত।
তারা প্রশ্ন করলো আমি দুবাই বুর্জ খলিফা নামক পাঁচ তারকা হোটেলে এক সপ্তাহ কার সাথে ছিলাম। এই বাজে প্রশ্নে আমি রেগে উঠি। বললাম, এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এছাড়া আমি জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রী। আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্স হয়ে দুবাই কেন আরো অনেক দেশে গিয়েছি, এমনকি বিভিন্ন সিনেমার শুটিংয়ে যেতে হয়েছে নানা দেশে, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড আরো কত দেশে।
রাগ থামিয়ে বললাম, আমি যে বক্তব্য দিলাম, সেটা নিয়ে প্রশ্ন না করে আমার কোথায় কি, তা নিয়ে আপনারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
যাহোক, এদিনই নানা মুখরোচক গল্পজুড়ে কত শত নিউজ হল। প্রিণ্ট, পোর্টালে এবং বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়।
আমি এর মধ্যে জেনে ফেলেছি, ‘স্কাই ক্লাবের’ পার্টনার এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি জনৈক এক ব্যক্তি কোন এক বাহিনি প্রধান। প্রচুর ক্ষমতাধর তিনি। আমি ঘাবড়াইনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের নমুনা দেখে বুঝেছি, এরা এসব ক্ষমতাধরদের দালাল সাংবাদিক, হলুদ সাংবাদিকতা তাদের করা ছাড়া উপায় নেই। তাদের হাতপা বাঁধা কোন এক শক্তির কাছে।
এরপরের ঘটনা আরো তিক্ত। আমি আমার স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করলাম। (চলবে)