প্রয়ান দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ পীর হবিবের রাজনৈতিক প্রকল্পের বিকল্প নাই
সৈয়দ এনামুল ইসলাম
পীর হবিব আমৃত্যু রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে ছিল রাজনীতি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যখন মৃত্যুর পুর্বে নিসংগতায় মৃত্যুশয্যায় শুয়েছিলেন তখনো তিনি রাজনীতির কথাই ভেবেছেন। এমন নয় যে তিনি রাজনীতির মাধ্যমে নীজের ও পরিবারের জন্য সুনাম কুড়াতে বা অর্থবিত্তের মালিক হতে চেয়েছিলেন। এমনো নয় যে এই অত্যন্ত মেধাবী মানুষটি রাজনীতি করেছেন অন্য কোন পেশায় উন্নতি করা সম্ভব ছিলো না বলে। তিনি নীজের ক্লীন ইমেজ ব্যবহার করে বিরাট চ্যারিটি নেতা হতে পারতেন কিন্তু করেননি। চ্যারিটি খারাপ কাজ এটা বলছি না, শুধু এ সত্যটি হাইলাইট করছি যে তিনি চ্যারিটি নয় রাজনীতিকেই নীজের জীবনের জন্য উত্তম কাজ হিসেবে গণ্য করেছিলেন।
কি ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য? কেন তিনি অন্য পেশায় না গিয়ে রাজনীতিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন?
এই প্রশ্নগুলো আমি শোষণ (exploitation) ও নিপীড়ন (oppression) দুটো কনসেপ্ট দিয়ে আলোচনা করবো। শোষণ বলতে শ্রেনী সমাজে পুঁজি বা সম্পদের মালিক কর্তৃক শ্রমিক বা উৎপাদককে অর্থনৈতিক বঞ্চনা করা বুঝায়। আর নিপীড়ন বলতে মানসিক নির্যাতন বুঝায়, যা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেও আপনা আপনিই দূর হয় না। যেমন নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা। শোষণ নিপীড়ন জাতিগত হতে পারে। যেমন বাংগালী জাতি হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে। পীর হবিবের রাজনীতি ছিল ব্যক্তি ও জাতীয় উভয় ধরনের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীদের পীর হবিব থেকে শিক্ষা নিতে হলে ইতিহাসের আলোকে তাঁর রাজনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় নেয়া জরুরী। তিনি রাজনীতির মধ্যে থেকেছেন আমৃত্যু, কারন তিনি মনে করতেন শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রধান বাহন রাজনীতি। তিনি এই সত্য জানতেন যে ব্যক্তিগত চ্যারিটি দিয়ে, লেখালেখি দিয়ে কিছু মানুষের উপকার করা যায় বটে, ব্যাপক মানুষের কোন উপকার করা যায়না। সমাজে আনা যায়না কোন মৌলিক পরিবর্তন। কিন্তু রাষ্ট্রের একটি ছোট আইন বা নীতির পরিবর্তনও দেশের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। আর সে পরিবর্তনে ভুমিকা রাখা সম্ভব একমাত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার মাধ্যমে।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শ্রেণীগত ও জাতিগত শোষণ ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের রাজনীতি করেছেন পীর হবিব ও তাঁর কমরেডরা। তাঁর মুল রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক সদ্য স্বাধীন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ‘ইয়ে আজাদী জুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়’ শ্লোগানের রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অসারতা তুলে ধরে ইহজাগতিকতা ভিত্তিক রাজনৈতিক এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসার কর্মসূচির অংশ। সে সময় মানুষকে শোষণ নিপীড়ন বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করতে তাদের মনোজগৎ থেকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চেতনার বিপরীতে ইহজাগতিক চেতনা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন ছিলো। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক প্যারাডাইম সিফট, যা বামপন্থীরা নীজেরা চরম মুল্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন এবং জাতিকে রাজনৈতিক সংগ্রামের উন্নততর স্তরে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছিলেন। ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পীর হবিব ও তাঁর ইহজাগতিকতাবাদী রাজনৈতিক জোট বিপুল ভোটে ইসলাম ধর্মীয় জাতীয়বাদীদের পরাস্ত করতে সক্ষম হলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই দুই শক্তির মধ্যে দ্বন্ধ ও সংগ্রাম চলতে থাকে একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইহজাগতিক শক্তির চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা, সংখ্যালঘূ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষা, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবী প্রভৃতি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জাতিগত শোষণ নিপীড়নের অবসান ঘটানো। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জিত হয় একাত্তর সালে। বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ইহজাগতিকতাকে রাজনীতির একমাত্র উপাদান হিসাবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কবরও রচিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে দ্বার উন্মোচিত হয় পীর হবিবের আজীবনের স্বপ্ন শোষণ-নিপীড়নমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সমাজের বৈপ্লবিক রুপান্তরের চুড়ান্ত রাজনৈতিক সংগ্রামের। কিন্তু সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তাঁদের কিছু ভুল-ভ্রান্তির সুযোগে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের নৃশংস পাল্টা আক্রমণে। ১৯৭৫ সালের নারকীয় সামরিক অভ্যুত্থান কেবলমাত্র ক্ষমতার পালা বদলের জন্য নয়, পীর হবিব ও তাঁর কমরেডদের রাজনৈতিক অর্জনকে ছিনিয়ে নিতেই মুলত এ রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। এই প্রতিবিপ্লবে পীর হবিবের রাজনৈতিক প্রকল্পের সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কিন্তু তাঁর ভাবাদর্শ ও মানব প্রগতির স্বপ্ন ধ্বংস হয়নি। এই স্বপ্ন যে বাংগালী জাতির মননে কত গভীরভাবে প্রথিত আছে তা দৃশ্যমান হয়েছিল ২০১৩ সালের গনজাগরণে।
পীর হবিব জানতেন কমরেডদের রিগ্রুপ হওয়া সম্ভব হলে, তাঁদের জনবান্ধব রাজনৈতিক দলটিকে পুনর্গঠন করা সম্ভব হলে, বর্বর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে আবারও পরাভুত করে শোষণ-নিপীড়নমুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণের সংগ্রামে কামিয়াব হওয়া সম্ভব। এজন্য তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দল পুনর্গঠনের জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হন নি।
বাংলাদেশের সুশাসন ও উন্নয়ন সংকটের মুল কারন আওয়ামীলীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা নয়, বরং দেশে সরকারকে একাউন্টেবল রাখা, বিকল্প নীতি উপস্থাপন করা এবং ব্যর্থ সরকারকে রিপ্লেইস করার মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ রাজনৈতিক দল বা জোটের অনুপস্থিতির মধ্যে নিহিত ছিল এ সংকট। আর এ শুন্যতা পূরণ করতে পারে পীর হবিবদের পুনরুজ্জীবিত রাজনৈতিক দলটি। বাংগালী জাতির বিকাশের অন্যতম প্রধান বাহন এই দলটি বাংলাদেশের একমাত্র দল যা কখনোই কোন ষড়যন্ত্র, হত্যা, সামরিক স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, দূর্ণীতি, সম্পদ দখল/পাচার এমনকি অনৈতিক পররাষ্ট্র নীতির দ্বারা নীজেদেরকে কলুষিত করেনি। তাই চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান এবং ২০১৩ সালের গনজাগরণ প্রজন্মের স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণের পথ খুলে দেয়ার জন্য এই দলটির বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফিরে আসার বিকল্প নেই।
লেখক: রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মী