বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ওয়েবিনার
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ ১৭ মার্চ বিকেল ৩টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মশতবার্ষিকীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজন করেছে এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার। সংগঠনের সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারের বিষয় ছিল ‘দেশে ও বিদেশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন উর্ধ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটির করণীয়।ওয়েবিনারের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা শিল্পী হাশেম খান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অবঃ) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডাঃ আমজাদ হোসেন, নির্মূল কমিটির নরওয়ে শাখা সভাপতি লেখক খোরশেদ আহমদ, নির্মূল কমিটির সুইজারল্যান্ড শাখা সভাপতি সমাজকর্মী রহমান খলিলুর, নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখা সভাপতি মানবাধিকারকর্মী একরাম চৌধুরী, ইন্দো-বাংলাদেশ ফোরাম ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজম-এর সংস্কৃতি সম্পাদিকা সংগীতশিল্পী শিউলি ভট্টাচার্য, নির্মূল কমিটির সর্ব ইউরোপীয় শাখা সভাপতি সমাজকর্মী তরুণ কান্তি চৌধুরী, নির্মূল কমিটির সর্ব ইউরোপীয় শাখা সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকারকর্মী আনসার আহমদউল্লা, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম, তুরস্ক-এর সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি, নির্মূল কমিটির যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস শাখা সভাপতি সমাজকর্মী মাহফুজুর রহমান ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল।
ওয়েবিনারের প্রারম্ভে সূচনা বক্তব্যে সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে সাড়ম্বরে পালনের বহুমাত্রিক উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণ করা হলেও জাতির পিতার রাজনৈতিক দর্শনÑ ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা ও বিশ্বশান্তির ব্যবস্থাপত্র দেশে কিংবা দেশের বাইরে প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বর্তমান বিশ্বে দেশে দেশে সংঘটিত সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাস ও বৈষম্যের প্রধান কারণ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, অমানবিক স্বৈরশাসন এবং আধিপত্যবাদ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান ১৯৭২-এর মূল সংবিধান, যা প্রকৃত অর্থে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের দর্পণ। এই সংবিধানে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ নির্মাণের পূর্বশর্ত হিসেবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অথচ বিএনপি-জামায়াতের মতো বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এখন ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ওয়াজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ’৭২-এর সংবিধান সহ ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম ও ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের প্রতি ক্রমাগত বিষোদগার করছে। তাদের হুমকির কারণে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সরকারি উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে শত শত মসজিদ বানানো হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর জীবনী থাকলেও তাঁর দর্শন অনুপস্থিত। ৫৭ ধারায় মুক্তচিন্তক তরুণদের গ্রেফতার করা হলেও যারা সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের ভাইরাস ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। নির্মূল কমিটি দেশে ও বিদেশে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শ তুলে ধরার জন্য বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা বাংলাদেশ সহ সংঘাতসংকুল বিশ্বে শান্তি, সাম্য ও মানবতা পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনÑ ১৯৭১-এর সাতকোটি মানুষের দর্শন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বুঝতে পারি, পাকিস্তান কখনই বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে গ্রহণ করেনি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কারণেই তিনি বাঙালির সকল নেতার ওপরে অবস্থান করছেন। দেশে ও বিদেশে নির্মূল কমিটির শাখাগুলোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন। তাঁর এই দর্শনের কারণেই তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এখনও বঙ্গবন্ধুর দর্শনের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে ষড়যন্ত্র অব্যহত রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন প্রচারের জন্য দেশে শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। অন্তত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ’৭২-এর সংবিধান সম্পর্কে পড়তে ও বুঝতে পারবে। ধর্মান্ধরা তাহলে মানুষের ওপর সাম্প্রদায়িক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।’
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেঃ কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ তথা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ অতীতের মতো সামনেও অন্ধকার দেখছি। সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের শক্তিকে বুঝে একে প্রতিহত করার জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধু অনুশাসন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু তথা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন বিস্তার করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনী, ইতিহাস ও তাঁর চেতনা তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা দেখছি না। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে এবং অনেক কর্মকর্তা শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর লোকদেখানো কাজ করছেন। এসব অপশক্তিকে প্রতিহত করে নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর দর্শনে আলোকিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে একত্রিত হয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও কিছুদিন ধরে মন্থরতা দেখছি। এ বিষয়েও সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেন, ‘তৃণমূলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ৫০ বছর ধরে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছি। জাতির পিতার ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রচারের ক্ষেত্রে কোথায় যেন সরকারের সংকীর্ণতা কাজ করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জীবনের ওপর আলোচনা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। শুধু দেশের বাইরে নয়, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিকল্পনা করে দেশেও একযোগে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ বছর স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সমাজসেবক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ডা. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রচারণা শিক্ষার্থীদের ভিতর ধর্মান্ধতার বীজ বপণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বহুদিন প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ এমনকি গণযোগাযোগ মাধ্যমও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের তথা বঙ্গবন্ধুর দর্শনের বিপরীত দর্শন প্রচার করেছে। এখনও সকল ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এসব ক্ষেত্রে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে, যেন পরবর্তী প্রজন্ম ভুল শিক্ষা না পায়। আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে পরিচিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি শান্তি পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
তুরস্কের টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজমের সাধারণ সম্পাদক শাকিল রেজা ইফতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন তুরস্কে প্রচারের ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু বিয়ন্ড বাউন্ডারিজ’ নামে আমি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও মানবিক দর্শনের ওপর বিদেশীদের অভিমত নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে তা প্রচারের ব্যবস্থা করব। তুরস্কের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও বিভিন্ন লেখা টার্কিশ ভাষায় অনুবাদ করে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছি। তাদের ভাবনাগুলো নিয়ে আমি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। অন্যান্য দেশেও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন প্রচারের জন্য এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।অনুষ্ঠানের শুরুতে নির্মূল কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী শিউলি ভট্টাচার্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অন্নদাশঙ্কর রায়ের কালজয়ী কবিতা’র সঙ্গীতভাষ্য পরিবেশন করেন।