বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনোয়ারা জাহান জেপি আর নেই: ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শোক

নিলুফা ইয়াসমীন
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী

লন্ডন:  ‘স্টপ জেনোসাইড, রিকোগনাইজ বাংলাদেশ, ইয়াহিয়ার আর্মী আউট আউট, তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে যারা ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের মাটি কাঁপিয়ে তুলেছিলেন তাঁদেরই অন্যতম একজন আনোয়ারা জাহান জেপি মৃত্যুবরণ করেছেন। শনিবার স্থানীয় সময় সকালে লন্ডনের লুইসাম হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহ ই ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৫ বছর। মৃত্যুকালে তিনি তিন সন্তান ও দুই নাতি নাতনি রেখে গেছেন। ৭২ সাল থেকে সাউথ ইস্ট লন্ডনের নিউক্রসের আসমিড রোডে বসবাস করছিলেন সদ্য প্রয়াত আনোয়ার জাহান জেপি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটেনে গঠিত বাংলাদেশ মহিলা সমিতির (বাংলাদেশ ওমেনস এসোসিয়েশন অব গ্রেট ব্রিটেন) সেক্রেটারী ছিলেন আনোয়ারা জাহান।
১৯৭১ সালে আনোয়ারা জাহান ও অন্যান্য নারী সংগঠকদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে প্রথম গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’। ১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিলে ১০৩ লেডবারি রোডের ছোট একটি ঘরে ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’র  জন্ম। সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রথমদিনেই মাত্র গুটিকয়েক বাঙালী নারী পাকিস্তানীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার দৃঢ় শপথ গ্রহন করেন। জেবুন্নেসা বক্স ছিলেন মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এবং আনোয়ারা জাহান সেক্রেটারী। লিলু বিলকিস বানু ছিলেন উপদেষ্টা। পরবর্তীতে তিনশ’র মত মহিলা যোগ দেন ঐ সংগঠনে। নব গঠিত সংগঠন ঐসময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে ব্যাপক তৎপরতা চালায়।
’৭১-এর ৪ এপ্রিল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে লন্ডনস্থ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতদের কাছে স্মারকলীপী দেয় মহিলা সমিতি। ১০ এপ্রিল টেলিগ্রাম পাঠানো হয় জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার  রাষ্ট্রনেতাদের কাছে। তাতে লেখা হয় – ‘বিশ্ব বিবেক সতর্ক হও’, ‘বন্ধ কর পাকিস্তানীদের হাতে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা’ ।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তানের দাতা দেশগুলোর কাছে আনোয়ারা জাহানরা আবেদন জানালেন,  ‘তোমাদের সাহায্য বন্ধ কর, পাকিস্তানকে সাহায্য করা মানে বাঙালীকে নিধন করা।’ তখন পাকিস্তানের বন্ধু ছিল চীন। চীনের রাষ্ট্রদূত ভবনের সামনে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানান আনোয়ারা জাহান ও তাঁর সহযোদ্ধারা। ১৮ এপ্রিল তাঁরা চীনের রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। ‘উইমেন টু উইমেন’ অর্থাৎ একজন নারীর কাছে আরেকজন নারীর ফরিয়াদ তুলে ধরা হয়। গৃহিনীদের উদ্দেশ্য করে লেখা হয় ‘তোমরাদের হাজব্যান্ডকে বুঝাও পাকিস্তানী আর্মীদের দ্বারা বাঙালী নারী ধর্ষণ বন্ধ করো, শিশু হত্যা বন্ধ করো, পুরো একটা  জাতিকে নিঃশেষ হতে দিওনা।’
এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় ব্রিটেনের পার্লামেন্ট অধিবেশনে এমপিদের কাছে লবিং। আনোয়ারা জাহানরা ঘন্টার পর ঘন্টা পালা করে পার্লামেন্টের দোরগোড়ায় বসে থাকতেন আর ভিতরে চিরকুট পাঠাতেন, সরকারী ও বিরোধী দলের এমপিদের কাছে। চিরকুটে লেখা থাকতো, ‘সংবাদপত্র আর প্রেসের খবর যদি তোমাদের বিশ্বাস না হয় তাহলে আমাদের কথা শুনো, আমরা দেশ থেকে চিঠি পেয়েছি, তাতে লেখা আছে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেক মেয়েকে আর্মীরা ধরে নিয়ে গেছে, অনেক বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে।’ পার্লামেন্টের অধিবেশনের অতিথিদের প্ল্যাকার্ড দেখানো হতো। তাদের কাছে পেশকৃত আবেদনপত্রে বলা হয়, ‘পাকিস্তানকে সেন্টা থেকে বহিস্কার করো, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও।’
১৭ এপ্রিল আনোয়ারা জাহানদের মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে প্ল্যাকার্ডসহ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়  ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটের সামনে। ছাত্ররাও যোগ দেয় তাদের সাথে। মহিলা সমিতির উদ্যোগে মায়েরা বাচ্চাদের হাত ধরে অফিসের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মায়েদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে মাইলের পর মাইল স্লোগান দিলে পরদিন প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের কথা লেখা হয়। ‘নট এ পেনি নট এ গান, টিক্কা ভূট্টো ইয়াহিয়া খান’ এই শ্লোগানটি পরের দিনের বহু সংবাদপত্রের হেড লাইন হয়। এতে রিলিফ অর্গানাইজেশনগুলোর টনক নড়ে। প্রচুর ওষুধ, খাবার, অর্থ সাহায্য ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠানোর খবর বের হয় ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলোতে।
মহিলা সমিতির সদস্যরা ‘এ্যকশন বাংলাদেশ’ এবং আরও কতকগুলো সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ্যইড বন্ধ করার আবেদন নিয়ে জার্মান ও অষ্ট্রিয়ান দূতাবাসে যান। সেখানে পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদ করে দূতাবাসের সামনে এক সদস্য এবং কিছু ছাত্র অনশন শুরু করে। পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুরোধক্রমে সদস্যরা অনশন ভঙ্গ করেন। প্যারিসেও এইড দানের সভায় এইড বন্ধ করার জন্য আবেদন নিয়ে কয়েক সদস্য দেখা করেন।

৩ ডিসেম্বর মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান আনোয়ারা জাহানরা। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান ও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে মিছিল করেন, হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্ণারে সভা করেন। সেখানে লেবার এমপি ডগলাস ম্যান বক্তৃতা করেন।

আনোয়ারা জাহান ও তাঁর সহকর্মীরা শুধু ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই নয়, বাংলাদেশের ভিতরেও  সাহায্য পৌঁছে দেবার উদ্যোগ নেন ঐসময়।‘এ্যাকশন ওমেগা’ নামের সংগঠনের এক সদস্য এ্যালেন কনেটের মাধ্যমে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভিতরে খাবার ও ঔষুধ পাঠাবার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। কিন্তু খাদ্য বিতরণের সময়ে এ্যালেন কনেট ধরা পড়েন। তাঁকে যশোর জেলে ছয় মাস আটক রাখা হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ও ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর মাধ্যমে ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরের শিশু ও মায়েদেরে জন্যও জামা কাপড় পাঠান তাঁরা। যুদ্ধে আহত মুক্তিসেনাদের আশু চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের কাছে ঐসময় আনোয়ার জাহানরা এক হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে ছিলেন।

 

একজন গুণী, কর্মঠ ও সংগ্রামী নারী আনোয়ারা জাহান জন্ম গ্রহন করেন ১৯৩৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে।
ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ’৫৯ সালে ইকোনমিক্স এবং ’৬৬ সালে সোসিওলজিতে তিনি মাস্টার্স করেছেন, সেই সঙ্গে টিচার্স ট্রেনিংও নিয়েছেন। স্মল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশনে রিসার্চ অফিসার হিসাবে চাকরী করেছেন। আনোয়ারা জাহান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে পড়াকালীন সময়ে কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারী ছিলেন। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন  সময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে শরীক হয়েছেন। বরাবরই অসহায় মেয়েদের জন্য এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কিছু করার বাসনা ছিল আনোয়ারা জাহানের।
দুই ছেলে এক মেয়ের জননী আনোয়ারা জাহান ১৯৬৭ সালে ব্রিটেনে এসেছিলেন উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে যাবেন এটাই ছিল আশা। অবস্থার বিবর্তনে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে টিচার্স ট্রেনিং করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরী ও কমিউনিটি ওয়ার্ক করেছেন। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফ্যাক্টরী ও পোষ্ট অফিসে কাজ করেছেন।
পরবর্তীতে মালবারী স্কুল, ডেইনফোর্ড স্কুল ও ক্যামডেন কমিউনিটি স্কুলে ফুলটাইম টিচার হিসাবে কাজ করেছেন আনোয়ারা জাহান। দশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে গ্রেড ওয়ান থেকে শুরু করে ডেপুটি হেড হয়েছেন। আনোয়ারা জাহান ব্রিটেনের স্কুলে বাংলা শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ সালে আরো কয়েকজন মিলে নর্থ লন্ডনের হিন্সবারী পার্কে বাংলা স্কুল চালু করেন তিনি। তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ‘বাংলা’র অন্যতম এক্সামিনার ছিলেন। বাংলা শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে আনোয়ারা জাহান, জেবুন্নেসা বক্স ও সুফিয়া রহমান মিলে ‘এসো বাংলা পড়ি’ নামে বই লিখেছেন।  লেখালেখির সঙ্গে সেই ছোটবেলা অর্থাৎ ১১ বছর বয়স থেকেই জড়িত আছেন আনোয়ারা জাহান। তিনি ছোটদের জন্য বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতার বইও বেরিয়েছে। আনোয়ারা জাহানের তিন ছেলেমেয়েই গ্রাজুয়েশন করেছেন। তিনজনই ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নিয়োজিত।
আনোয়ারা জাহান প্রথম বাঙালী মহিলা, যিনি জাস্টিস অফ পিস হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে থেকে দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি এই সম্মানজনক পদে (জেপি) কাজ করেছেন। তিনি কমিশন ফর রেসিয়াল ইকুয়ালিটির কমিশনার হিসাবে অভিবাসী মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আনোয়ারা জাহান আরো যে সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেগুলো হলো: ইউনাইটেড কিংডম ইমিগ্রান্টস এডভাইজারী সার্ভিসের এক্সিকিউটিভ মেম্বার, এশিয়ান ফোরামের ডেপুটি চেয়ার এবং ইউকে এন্ড ইউরোপ বাংলাদেশ ফোরামের ডেপুটি চেয়ার।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শোক
এদিকে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনোয়ারা জাহানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা। এক বিবৃতিতে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সদ্য প্রয়াত আনোয়ারা জাহানকে বাঙালির শ্রেষ্ট সন্তানদের অন্যতম একজন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হোক বা নাহোক, মুক্তুযুদ্ধের ইতিহাসে আনোয়ারা জাহানের নাম আজীবন উজ্জ্বলতা ছড়াবে। তাঁরা বলেন, জাতীয় ঋন পরিশোধের দায় থেকে হলেও আনোয়ারা জাহানের কর্মের সরকারী স্বীকৃতি দেয়া উচিত। নেতৃবৃন্দ প্রয়াত আনোয়ারা জাহানের আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জানান।

 

You might also like