বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনায়
স্পোর্টস ডেস্ক
সত্যবাণী
লন্ডন: বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা।অবশেষে ফুরোলো অপেক্ষা। ৩৬ বছরের অপেক্ষা। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে ৪-২ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিল আলবিসেলেস্তেরা। ঋণ শোধ করে বিশ্বকাপ মেসির হাতে তুলে দিচ্ছে ফুটবল। এই ফুটবলই তাকে কাঁদিয়েছিল, এই ফুটবলই তাকে এনে দিয়েছে গৌরব। অমরত্ব বুঝি এভাবেই আদায় করে নিতে হয়। লিওনেল মেসি নিয়েছেন। তাকে নিয়ে দিয়েছেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস। আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মার্তিনেসের নাম। টাইব্রেকারে কিংসলে কোমানের শট তিনি না ঠেকালে হয়তো কিছুই হয়তো না।
বিশ্বকাপ ফাইনাল আর কখনো হয়নি। যিনি এই চিত্রনাট্য লিখেছেন, তিনি শত শত রোমাঞ্চকর সিনেমাকেও আজ হার মানিয়েছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অভাবনীয়! ফাইনাল এমনও হতে পারে? এতো রোমাঞ্চ! মেসিরা যেখানে পান অমরত্বের ছোঁয়া, যেখানে কিলিয়ান এমবাপ্পেরা ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত সৈনিক হিসেবে থাকেন। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ২-২ গোলে সমতা থাকার পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৮ মিনিটে দারুণ এক গোলে আবারও আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন লিওনেল মেসি। কিন্তু রোমাঞ্চের তখনও শেষ নয়। আবারও ফ্রান্সের ত্রাণকর্তা কিলিয়ান এমবাপ্পে। ১১৬ মিনিটে ডি বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করে বসেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার মন্তিয়েল। পেনাল্টি থেকে নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করেন এমবাপ্পে। কিন্তু তা ভেস্তে গেল টাইব্রেকারে।
ভাগ্য নির্ধারণের খেলায় নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। সেদিন নায়ক ছিলেন মার্তিনেস, আজও তিনিই সেই ত্রাণকর্তা। টাইব্রেকারে প্রথম শটে গোল করেন এমবাপ্পে ও মেসি। ফ্রান্সের হয়ে দ্বিতীয় শট নেওয়া কোমানকে ঠেকিয়ে দেন মার্তিনেস। অন্য দিকে জাল মিস করেননি আর্জেন্টিনার পাওলো দিবালা। তৃতীয় শট নিতে এসে পোস্টের বাইরে অরেলিয়ে চুয়ামেনি। আর্জেন্টিনার হয়ে লেয়ান্দ্রো পারদেস গোল করলে আবারও পিছিয়ে যায় ফ্রান্স। চতুর্থ শটে কোলো মুয়ানি গোল করলেও আর্জেন্টিনাকে স্বপ্নের বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার মুহূর্তটা আজীবন মনে রাখবেন গনসালো মন্তিয়েল। দারুণ ভাবে ফ্রান্স গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে আলবিসেলেস্তেদের আনন্দের বৃষ্টিতে ভেজান তিনি। ট্র্যাজিক নায়কে পরিণত করেন এমবাপ্পেকে।
অথচ লুসাইল স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধে খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও সেই একই অবস্থা। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে ৩৬ বছর পর বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখছিলেন লিওনেল মেসিও। কিন্তু বোতলবন্দী কিলিয়ান এমবাপ্পে যেন গ্রিক রূপকথার মতো ঠিক ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠলেন। ৭৯ মিনিট পর্যন্ত যাকে অসহায় মনে হচ্ছিল। সেই তিনিই দুই মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে বদলে দিলেন ফাইনালের চিত্রনাট্য। ম্যাচে ফিরল ফ্রান্স। ফাইনাল যেন একেই বলে!
আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি আগেই বলেছিলেন, ফ্রান্সকে আটকানোর পরিস্কার পরিকল্পনা আছে তার। কথার সঙ্গে কাজের একদম হুবহু মিল দেখিয়েছেন তিনি শুরুর দিকে। বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের রেফারি বাঁশি পর থেকেই চেপে ধরে আলবিসেলেস্তেরা। ২১তম মিনিটে বাঁ দিক থেকে হুলিয়ান আলভারেসের পাওয়া বল বক্স থেকে শট নিতে যাচ্ছিলেন আনহেল দি মারিয়া। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাকে ধাক্কা দিয়ে বসেন উসমান দেম্বেলে। সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। স্পট কিক থেকে সহজেই আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন মেসি। শুধু তা-ই নয়, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার কীর্তি গড়লেন তিনি। তাছাড়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ২৬ ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার।
৩৬তম মিনিটে উপমেকানোর ভুলে নিজেদের অর্ধে বল পায় মেসি। দারুণ দক্ষতায় মাক আলিস্তারকে বল বাড়ান তিনি। টেনে নিয়ে বক্সে আলিস্তার খুঁজে নেন দি মারিয়াকে। দারুণ এক শটে লরিসকে পরাস্ত করে বল জালে পাঠান জুভেন্টাসের এই ফরোয়ার্ড। ব্যবধান দ্বিগুণ করে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। বিরতির আগেই আক্রমণভাগে দুই পরিবর্তন আনেন ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এমবাপ্পেও সে ভাবে বিপদ সৃষ্টি করতে পারেননি।
কিন্তু ২৩ বছর বয়সি এই ফরোয়ার্ড মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন যে কোনো সময়ে, যে কোনো মুহূর্তে। এমনি এমনি তো আর তাকে সময়ের সেরা বলা হয় না। ৭৯ মিনিটে কোলো মুয়ানিকে বক্সের ভেতর ফাউল করে বসেন ওতামেন্দি। পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। স্পট কিক থেকে গোল করেন এমবাপ্পে। এর ঠিক পরের মিনিটেই সমতা ফিরিয়ে চমকে দেন তিনি। থুরামের সঙ্গে দেওয়া নেওয়ার পর দারুণ ভলিতে এমিলিয়ানো মার্তিনেসকে পরাস্ত করেন এই ফরোয়ার্ড।
খেলার যোগ করা সময়ে জালকে লক্ষ্য করে বক্সের বাইরে থেকে অসাধারণ এক শট নেন মেসি। কিন্তু দুর্দান্ত দক্ষতায় ফ্রান্সকে ফাইনালে টিকিয়ে রাখেন ফ্রান্স অধিনায়ক হুগো লরিস। তবে অতিরিক্ত সময়ের ১০৮ মিনিটে লাউতারো মার্তিনেসের শট ঠেকিয়ে দিলেও ফিরতে শটে মেসিকে আটকাতে পারেননি তিনি। এর দশ মিনিট পর তাকে হারের হাত থেকে বাঁচান এমবাপ্পে। কিন্তু লরিস শেষরক্ষা করতে পারলেন কই। ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালের পর আবারও বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার হাতে। রোসারিওতে জন্ম নেওয়া সেই ফুটবল জাদুকরের হাতে। এমন স্বপ্ন তো কবে থেকেই দেখে আসছিলেন আর্জেন্টিনা ভক্তরা। এখন তারা বসবাস করছেন বাস্তবে!