ব্রাসেলস প্রেস ক্লাবে নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠান: একাত্তরের শহীদদের স্মরণ করলেন বিশ্ব মানবাধিকার নেতারা
সৈয়দ আনাস পাশা
সম্পাদক, সত্যবাণী
ব্রাসেলস থেকে: আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল ব্রাসেলসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিহত বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নেতারা।
শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত দুই দিনব্যাপি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনে ব্রাসেলস প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি এই শ্রদ্ধা জানান বিশ্ব মানবাধিকার নেতারা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নেতা, সাবেক ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট মেম্বার পর্তুগিজ রাজনীতিক, সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক মি. পাওলো কাসাকার সভাপতিত্বে এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীরের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে মানবাধিকার নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন, ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেসের সভাপতি ড. লাকুমার লোহানা, তুরস্কের সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটির প্রেসিডেন্ট মি. ফেরহাত আতিক, পোলান্ডের মানবাধিকার সংগঠন নেভার এগেইনের চেয়ারম্যান, সমাজ বিজ্ঞানি ড. রাফাল পেঙ্ককোয়াস্কি, জার্মানিতে নির্বাসিত আফগান নারী মানবাধিকার সংগঠক আরিয়া সুরিয়া, বেলজিয়ামের হিউম্যান রাইট উইদাউট ফ্রন্টিয়ারস ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক অধ্যাপক উইলী ফাউত্রে, বেলুচ হিউম্যান রাইট কাউন্সিলের নির্বাহী সভাপতি ও যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার নেতা লেখক ড. নাসির দাস্তি, বার্মায় রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সন্ত্রাস তদন্তে নাগরিক কমিশনের সদস্য যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনিয়া স্টেট ইউনিভারসিটির অধ্যাপক শান্তি কর্মি ড. এবিএম নাসির, পোলান্ডের নেভার এগেইনের সদস্য মানবাধিকার নেত্রী নাটালিয়া সিনায়েভা পাঙ্কোভস্কা, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ভারতীয় লেখক প্রীয়জিৎ দেব সরকার, বেলজিয়ামের মানবাধিকার নেতা অ্যান্ডি ভার্মাট, উজবেকিস্তানের মানবাধিকার নেতা ফায়জুলো নেমাতোভ, বুরুন্ডির সমাজকর্মি আমিসা এনতাকিরুতিমান এবং রুয়ান্ডার মানবাধিকার নেতা অ্যান্ডরু রুবান জাঙ্গাবো।
শহীদ বুদ্দিজীবি অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর পুত্র মানবাধিকার কর্মি আসিফ মুনির তন্ময়ের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে দাখিলকৃত স্মারকলিপি পড়ে শোনান, নির্মুল কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক শহীদ বুদ্ধিজীবি ডাঃ আলিম চৌধুরীর কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। নির্মূল কমিটি ইউরোপীয়ান শাখার সভাপতি তরুণ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আনসার আহমেদ উল্লাহসহ সংগঠনের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাখা নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেসের সভাপতি ড. লাকুমার লোহানা তাঁর আবেগঘন বক্তব্যে একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে বলেন, মূলত এই গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরী করা হয়েছিলো ১৯৫২ সালে বাঙালির ভাষা কেড়ে নেয়ার অপচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্ত বীর বাঙালী রক্ত দিয়ে তাদের ভাষা রক্ষা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ৩০ লক্ষ জীবন দিয়ে নিজেদের ভূখন্ড থেকে তাড়িয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদারদের। তিনি বলেন, সিন্ধি জাতি পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্পেষণ থেকে বেড়িয়ে আসতে আজ যে সংগ্রাম করছে, সেই সংগ্রামে বাঙালী জাতিই মূলত আমাদের মূল অনুপ্রেরণা।
বেলুচ হিউম্যান রাইট কাউন্সিলের নির্বাহী সভাপতি ড. নাসির দাস্তি বলেন, বাঙালীর ভাগ্য ভবিষ্যতে আমাদেরও বরণ করতে হবে, এটি বালুচরা সেই একাত্তরেই বুঝেছিলো বলেই বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে আমাদের সমর্থন ছিলো। আজ থেকে অর্ধ শতাব্দি আগের বাঙালীর সেই সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই আমরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।
পোলান্ডের মানবাধিকার সংগঠন নেভার এগেইনের চেয়ারম্যান ড. রাফাল পেঙ্ককোয়াস্কি বলেন, পৃথিবীতে ‘আর কোন গণহত্যা নয়’, এই স্লোগানের পাশাপাশি ‘সব গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিচার চাই’- এই স্লোগানও তুলতে হবে শান্তিকামী বিশ্বকে। একাত্তরের বাঙালী গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমেই এটি করতে হবে আমাদের।
তুরস্কের সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটির প্রেসিডেন্ট মি. ফেরহাত আতিক বলেন, ধর্মের নাম নিয়ে একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী যে গণহত্যা সংগঠিত করেছিলো তা পৃথিবীর তাবৎ ধর্মবিশ্বাসীদের কপালের কলঙ্কতীলক বলেই আমি মনেকরি। এই কলঙ্কতীলক মুছতেই প্রয়োজন এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন বিশ্ব সম্প্রদায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানের সভাপতি সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক মি. পাওলো কাসাকার আমেরিকা ও ইউরোপের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে উপদেশের বুলি আওড়ান, অথচ অর্ধশতাব্দি আগে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার মাধ্যমে লঙ্ঘিত মানবাধিকারের স্বীকৃতির বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান, এ কেমন দ্বিচারিতা। তিনি বলেন, একাত্তরের বাঙালী গণহত্যা সভ্যতার কলঙ্ক। সভ্যতার ঠিকাদার হিসেবে নিজেদের পরিচয় স্টাবলিশ করার জন্য হলেও এই গণহত্যার স্বীকৃতি দিন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তা নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাঙালী গণহত্যার স্বীকৃতি ও এর সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আন্দোলনে বিশ্ব মানবাধিকার নেতাদের অব্যাহত সমর্থনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারনে বিশ্বের শক্তিধর কোন কোন রাষ্ট্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও পৃথিবীর তাবৎ শান্তিকামী মানুষ ছিলেন এই সংগ্রামের পক্ষে। ৫০ বছর আগে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের আজকের আন্দোলনে মানবাধিকার নেতাদের এই অভূতপূর্ব সমর্থন প্রমান করে, মানবতার পক্ষেই শান্তিকামী মানুষের অবস্থান। আমরা কৃতজ্ঞ।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিন এশীয় গণসম্মেলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।