মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
॥ষোল॥
‘বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম হাসপাতাল’-এ সকালে ৯ টায় পৌঁছি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বাজার এবং গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে লোকজন জমতে থাকে। হাসপাতালের স্টাফ নার্স আমার হাতে সমজে দেন গতকালকে কতিপয় অফিসারদের দেয়া সমুদয় কাগজপত্র। তালা দেয়া হাসপাতাল গেটে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব হয়ে এসব কাগজপত্র নেড়েছেড়ে দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে জড়ো হন বেশ কিছু তরুণ। যারা এতদিন আমার গড়ে তোলা বইটিকর ক্রীড়া সংঘ-এর সদস্য। কিছু লোক এলেন আমার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের বইয়ের পাঠক। এছাড়া জড়ো হয়েছেন বৎসরে একবার ঘুড়ি প্রতিযোগিতার ছোট ছোট বন্ধুরা।
আমি এখানে আসার পর প্রতিবছর কয়েকটি দিন পালন বা উদযাপন করি, এর মধ্যে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রæয়ারি শহীদ দিবস এবং পয়লা বৈশাখ নববর্ষ। নানা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হয়। এদিনগুলোতে শ্যামগঞ্জ বাজার ও বইটিকর গ্রাম রঙিন হয়ে ওঠে। মাইকে দেশাত্বকবোধক গান বাজে। বাচ্চারা উৎফুল্ল হয়। উপরি দোকানে পসরা নিয়ে বসেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। মেলা মেলা ভাব বিরাজ করে বইটিকর সর্বত্র।
আমি যখন সিলেটের চেম্বারে রোগী নিয়ে ব্যস্ত এমনি সময় ফোন এলো ‘শ্যামগঞ্জ বাজারের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধ প্রজন্ম হাসপাতাল’ থেকে। ফোন করেছেন ডিউটিরত ডাক্তার আহমেদ আজিজ। বিষয়: একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে এক দল পুলিশ আমাদের হাসপাতালটি সিলগালা করছেন। চমকে উঠি। বলি, কেন?
হাসপাতালটির নামের সাথে ঠিকানা ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’ বৈধ নয়। এবং সেই সঙ্গে যে ভূমির ওপর হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছে, সে ভূমিটি সরকারি সম্পত্তি। আমাদের কেনা সঠিক নয়। এ ভূমি কোনদিনই ব্যক্তি মালিকানায় ছিল না। এ্যাভাÐেন্ট বা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি।
গতকাল এ ঘটনাটি ঘটে যখন, সে সময় এদের মধ্যে অর্থাৎ আমার আসার পর উপস্থিত হওয়া তরুণদের অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন। তারা ঐ অফিসারদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন। আমার অনুমতি ছাড়া তারা তখন কোন ফ্যাসাদ করতে যায়নি। অনেকে আমাকে বলেছেন, এত থমথমে পরিস্থিতি ছিল, হয়ত কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমিও ফোনে তাদের বারণ করেছি, যা হয় আইনের মাধ্যমে হবে। আইনের উর্ধে কেউ নয়।
আমাদের লোকদের বের করে যারা হাসপাতালটি তালা দিলেন এবং নির্দেশ দিয়ে গেলেন এক সপ্তাহের ভেতর ভবনটি ভেঙে জমি খালি করার জন্য, তারা বা সংশ্লিষ্ট অফিসের লোক এর আগে আমাকে কোন নোটিশ দেননি। ধারাবাহিক কোন নোটিশ ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটল তা সকলকেই অবাক করে।
বিকেলে পৌঁছি জেলা ভূমি অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি কয়েক বছর এক নাগাড়ে আমাকে বহু চিঠি প্রদান করা হয়েছেÑযার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু আমি কোন চিঠি পাইনি, কে বা কারা সবগুলো চিঠি গায়েব করেছে। মনে হল, যারা-ই এর পেছনে থাকুক, মূলত বিশাল ষড়যন্ত্র রয়েছে।
আইনজীবীর মাধ্যমে কোর্টে একটি মামলা টুকে হতবাক হয়ে ফিরে আসি সিলেট শহরে, বাসায়। লন্ডনে থাকা মা সেলিনা আজাদকে অবহিত করি, বিস্তারিত জানার পর তিনি বললেন, চলে এসো লন্ডনে। আমিও আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম।
পরের দিন বিষয়টি সরেজমিনে দেখার পর ফিরে আসতে আমি যখন শ্যামগঞ্জ বাজার অতিক্রম করি, সে সময় দেখলাম বেশ কয়েকটি দোকানের নাকের ডগায় লাগানো সাইনবোর্ড ‘আলীগঞ্জবাজার’। এর আগে কোন সাইনবোর্ড ছিল না এসব দোকানে। এই সাইনবোর্ড লাগানোর পেছনে কোন কারসাজি, না ষড়যন্ত্র রয়েছে তা কে জানে? আমার সরল মস্তিষ্কে ভিলেজপলিটিক্স শব্দটিই কাজ করে না, কাউকে শত্রু ভাবার অবকাশ নেই আমার। বাবা আহমেদ আজাদ জীবিত থাকলে তিনি বুঝতেন, বিষয়টি কী। তবে একেবারে যে বুঝি না তা নয়, গভীরে প্রবেশ করলে, এত কঠিন পরিস্থিতির ধুম্রজালে আমার দশা হবে ভিলেজ পলিটিশিয়ান, ডাক্তার নয়। তাই, এ থেকে সরে আসতেই মন অস্থির হয়ে ওঠে। কোন এক মাতাল বাঁশি আমাকে তাড়া করছে তখন একটানা। (চলবে)