‘মামুনুলের পরিকল্পনায় মুনিরের নেতৃত্বে আল্লামা শফীকে হত্যা’

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

চট্টগ্রাম: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসা মামুনুল হকসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির প্রয়াত শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে।অভিযুক্তরা সবাই হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে আহমদ শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন বাদি হয়ে চট্টগ্রামের তৃতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দে’র আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।মামলার পর আহমদ শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন অভিযোগ করেন,হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নবনির্বাচিত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের পরিকল্পনা এবং আরেক যুগ্ম-মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনিরের নেতৃত্বে আল্লামা আহমদ শফীকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।

তিনি বলেন,আল্লামা আহমদ শফী একজন বিশ্ববরেণ্য আলেম।ওনাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর মামুনুল হক ঢাকা থেকে ফটিকছড়িতে এসে (জুনায়েদ) বাবুনগরীর বাসায় বসে ওয়ালিমার অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে অন্য আসামিদের নিয়ে মিটিং করেন। পরে সেখান থেকে ঘোষণা দেয়া হয় হুজুরের ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা না হলে হুজুরকে চরম মূল্য দিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে ১৬ তারিখ হাটহাজারী মাদরাসায় আন্দোলন শুরু হয়।’

প্রশ্ন রেখে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘মামুনুল হক তাহলে চরম মূল্য বলতে কী বুঝিয়েছিলেন সেদিন, হুজুরের মৃত্যু? এটা বলতে আমরা বুঝেছি তাকে হত্যার পরিকল্পনা।তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হুজুরকে অক্সিজেন খুলে নিয়ে, রাইস টিউব খুলে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যখন মেডিকেলে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা মাদরাসার দরজায় আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময় মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনিরের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে হুজুরের অক্সিজেন খুলে নেয়া হয়।এসব আমরা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছি।’

‘যে মাদরাসায় ছাত্ররা ফ্রি খায়, ফ্রি থাকে সেখানে আন্দোলন হতে পারে না’ দাবি করে তিনি আরো বলেন,যেখানে ৮ হাজার ছাত্র ফ্রি খায় সেখানে আবার কিসের আন্দোলন? হাটহাজারী মাদরাসায় কোনো আন্দোলন ছিল না।৫১ বছর বয়সে কওমি মাদরাসায় আমি সর্বপ্রথম আন্দোলন দেখলাম হাটহাজারীতে।আল্লামা শফীকে হত্যার পেছনে ‘উগ্রবাদী’ শক্তির হাত আছে দাবি করে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘উগ্রবাদীরা এখানে জড়িত, বর্তমান হেফাজতের যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে এই উগ্রবাদীদের নামও আছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কায়দায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আমার ভগ্নিপতিকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছোট ভাগনে আনাস মাদানীকে বাবার জানাজায় পর্যন্ত আসতে দেয়নি।

তিন মাসেও ঘটনা তদন্তে হেফাজত নেতাদের আশ্বাস পাননি জানিয়ে মাইনুদ্দিন আরো বলেন, ‘আমি গত তিন মাস পর্যন্ত হেফাজতের বড় বড় নেতার কাছে গিয়ে এর প্রতিকার চেয়েছি। কিন্তু তারা কোনো আশ্বাস না দেয়ায় শেষ পর্যন্ত আমি আদালতের কাছে বিচারের প্রার্থনা করেছি। মাননীয় আদালত আমার বক্তব্য শুনে পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।’বাদি মোহাম্মদ মঈন উদ্দিনের আইনজীবী আবু হানিফ বলেন, ‘মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে আহমদ শফীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এবং হত্যার অভিযোগে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আদালত মামলা গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। একমাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির ও মামুনুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস এবং হাবিব উল্লাহ, আহসান উল্লাহ, জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, নুরুজ্জামান নোমানী, আব্দুল মতিন, মো. শহীদুল্লাহ, মো. রিজওয়ান আরমান, মো. নজরুল ইসলাম, হাসানুজ্জামান, এনামুল হাসান ফারুকী, মীর সাজেদ, জাফর আহমদ, মীর জিয়াউদ্দিন, আহমদ, মাহমুদ, আসাদউল্লাহ, জোবায়ের মাহমুদ, এইচ এম জুনায়েদ, আনোয়ার শাহ, আহমদ কামাল, নাছির উদ্দিন, কামরুল ইসলাম কাসেমী, মোহাম্মদ হাসান, ওবায়দুল্লাহ ওবাইদ, জুবায়ের, মোহাম্মদ, আমিনুল হক, রফিক সোহেল, মোবিনুল হক, নাঈম, হাফেজ সায়েমউল্লাহ ও হাসান জামিল।মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো ৮০-৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া সাক্ষী করা হয়েছে ছয়জনকে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর শতবর্ষী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফী’র জীবনাবসান হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বড় মাদরাসা হিসেবে হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসার মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। তিনদিন ধরে ওই মাদরাসায় আহমদ শফীকে অবরুদ্ধ করে ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এর মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ শফীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর থেকে শফীর অনুসারীরা তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে আসছিলেন।মামলার আরজিতে অভিযোগ করা হয়েছে, আহমদ শফীর মৃত্যুর আগে ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগর এলাকায় মামুনুল হকসহ আসামিরা বৈঠক করেন। সেই বৈঠক থেকে শফীপুত্র আনাস মাদানীকে মাদরাসার শিক্ষা পরিচালক থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। তাকে বহিষ্কার করা না হলে আহমদ শফীকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

এর ধারাবাহিকতায় ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে একদল উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রকে মাঠে নামানো হয়। তারা আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে উগ্র ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে স্লোগান ও গালিগালাজ করতে থাকে। আহমদ শফীর কার্যালয়ে অনধিকার প্রবেশ করে আসামি নাছির উদ্দিন ‍মুনির ধমকের সুরে বলেন, ‘তুই হচ্ছিস বুড়ো শয়তান, তুই মরবি না, তুই সরকারের দালাল।’ ৪০-৫০ জন শফীর কক্ষে গিয়ে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করে ওই পদে হেফাজতের বর্তমান আমীর জুনাইদ বাবুনগরীকে বসানোর দাবি করতে থাকেন। শফী রাজি না হওয়ায় মামুনুল হকের মোবাইলে নির্দেশমতে নাছির উদ্দিন মুনির তার দিতে তেড়ে যান, শফী বসা অবস্থায় চেয়ারে লাথি মারেন। নাকের অক্সিজেন টান দিয়ে খুলে ফেললে শফী অজ্ঞান হয়ে যান। এ সময় মাইকে ঘোষণা করা হয়, আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং শফী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

আরজিতে আরো অভিযোগ করা হয়, ১৭ সেপ্টেম্বর আসামিদের কয়েকজনের নেতৃত্বে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা আনাস মাদানীর কক্ষে ঢুকে সেখান থেকে নগদ ২৮ লাখ টাকা, স্ত্রী ও মেয়ের ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নেন। মাওলানা ওমরের কক্ষ থেকে নগদ ৪০ লাখ টাকা, মুফতি ওসমানের কক্ষ থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা ও মাওলানা দিদারের কক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা লুট করে নেয়।ওইদিন বিকেলে শফীকে জিম্মি করে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার ও তার পদত্যাগের ঘোষণা মাইকে বলার জন্য চাপ দেন আসামিরা। তিনি অনীহা প্রকাশ করলে তার কক্ষের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্যুতের অভাবে অক্সিজেন লাগাতে না পারায় শফী কোমায় চলে যান। তাকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মাদরাসা থেকে বের করে হাসপাতালে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, শফী কোমায় চলে গেছেন। পরের দিন ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।আরজিতে বলা হয়েছে, ‘আসামি নাছির উদ্দিন মুনির ও মামুনুল হকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় মাদরাসায় ভাংচুর করে শাহ আহমদ শফীকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে এবং উনাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে না দেওয়ার মাধ্যমে প্রাণে হত্যা করা হয়েছে। মাদরাসা অবৈধভাবে গ্রাস করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববরেণ্য এই ইসলামী চিন্তাবিদকে হত্যা করেছে।আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তার ছেলে আনাস মাদানী জানাজায় যেতে চাইলে তাকে মারধর করে জখম করে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি বলে আরজিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৪৪৮, ৪২৭, ১১৭, ৩২৩, ৩৪১, ৩৮০, ৩০৪, ৫০৬ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ এনেছেন বাদি।শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বেই প্রায় একযুগ আগে গঠিত হয়েছিল আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। শুরু থেকেই আহমদ শফী সংগঠনটির আমীর এবং জুনাইদ বাবুনগরী মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। জুনাইদ বাবুনগরী ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ ও সমাবেশের কর্মসূচির পর ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। রক্তক্ষয়ী ওই কর্মসূচির পর বাবুনগরীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখন থেকেই তিনি তীব্রভাবে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এবং জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পান।

রক্তক্ষয়ী ওই কর্মসূচি পালনের পর বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় হেফাজতে ইসলামের মধ্যে আহমদ শফী ও বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে দু’টি ধারা তৈরি হয়। শফী যে মাদরাসার পরিচালক ছিলেন, বাবুনগরী একই মাদরাসার সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের ১৭ জুন বাবুনগরীকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাদের বিরোধ আরও দৃশ্যমান হয়।তবে তিনমাসের মাথায় ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে বাবুনগরীর অনুসারীরা শফীর অনুসারীদের পেছনে ফেলে দেন। শফীর মৃত্যুর দুইমাসের মাথায় প্রতিনিধি কাউন্সিল করে হেফাজতে ইসলামের আমিরের পদে বসেন বাবুনগরী। হেফাজতের কমিটি থেকে শফীপন্থীদের ‘আউট’ করা হয়।

You might also like