মৃত্যুবার্ষিকীতে ভার্চুয়াল স্মরণ সভা: পীর হবিব ছিলেন ইতিহাসের নেপথ্য নায়ক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী

লন্ডন: বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির কিংবদন্তী পুরুষ প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমান  শুধু একজন রাজনীতিকই ছিলেননা, তিনি ছিলেন বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের এক নেপথ্য নায়ক। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ-বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকেই পীর হবিবুর রহমানের ছিলো নেতৃত্বের ভূমিকা। আত্মপ্রচার বিমূখ ছিলেন বলেই এইসব অধিকাংশ ভূমিকা পালনের সময়েই তিনি নেপথ্যে থাকতেন। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজনীতির যে একঝাঁক নায়ক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে পীর হবিবুর রহমান অন্যতম হলেও, তিনি সবসময় প্রকাশ্যে নয়, থাকতেন নেপথ্যে। আর এজন্যই আমরা তাঁকে বলি ‘ইতিহাসের নেপথ্য নায়ক’।

প্রয়াত পীর হবিবুর রহমানের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘রাজনীতির শুদ্ধ পুরুষ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল স্মরণসভায় উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন পীর হবিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, ষাটের দশকের কিংবদন্তী ছাত্রনেতা, প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিক, ঐক্যন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এক সময়ের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ‘প্রগতি মঞ্চ’ এবং পীর হবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন, ইউকে’র যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন পীর হবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন, ইউকে’র সভাপতি আজিজ চৌধুরী। অনলাইন সংবাদমাধ্যম সত্যবাণী’র প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছাড়াও অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন, ষাটের দশকের আরেক কিংবদন্তী ছাত্রনেতা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, জাতীয় নেতা রাশেদ খান মেনন এমপি।  সম্পৃক্ত ছিলেন ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান শরীফ, ঐক্য ন্যাপ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুল মোনায়েম নেহরু, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, পীর হবিবুর রহমানের রাজনৈতিক অনুসারী এডভোকেট তবারক হোসেইন, পীর হবিবুর রহমানের রাজনৈতিক অনুসারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিষ্ট সুব্রত বিশ্বাস, বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মামুদ এ রউফ, প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব সৈয়দ জগলুল পাশা, মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক তাজুল মোহাম্মদ, প্রবীন বাম এক্টিভিষ্ট বিদ্যুৎ রঞ্জন দে, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীন সাংবাদিক, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা হাসান, সিপিবি, যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রকিব, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হরমুজ আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই, ইউকে’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব, পীর হবিবুর রহমানের রাজনৈতিক অনুসারী ডা: এনামুল চৌধুরী, ডা: আবুল খান সামাদ, ডা: মানষ কান্তি দাশ, ন্যাপের মূখপত্র সাপ্তাহিক নতুন বাংলার সম্পাদক পরিতোষ দেবনাথ, এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সিলেট জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা রুহুল কুদ্দুস বাবুল, সিলেট জেলা ঐক্যন্যাপ সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা সুবল চন্দ্র পাল, যুক্তরাজ্য ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান, সাবেক যুক্তরাজ্য সিপিবি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ এনাম, এক সময়ের বাম রাজনীতিক আবুল কাশেম, কামাল খান, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখার উপদেষ্টা বেগম হুসনা মতিন,  সাধারণ সম্পাদক জামাল খান, যুক্তরাজ্য উদীচী সভাপতি হারুনুর রশীদ, মুক্তিযোদ্ধা আমান উদ্দিন, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সত্যব্রত দাশ স্বপন, মসুদ আহমদ, সাবেক ন্যাপ নেতা এম এ মান্নান, সিলেটের প্রয়াত প্রবীন জননেতা জনাব আব্দুল হামিদের পুত্র এম এ মান্নান, পীর হবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন, ইউকে সাধারণ সম্পাদক মহিব উদ্দিন এবং পীর হবিবুর রহমানের পুত্র মনজুর হোসেন ও নাতি ইসমাইল হোসেন প্রমূখ।

অতিথির বক্তৃতায় রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, পীর হবিবুর রহমানের জীবনের ধ্যানজ্ঞান ছিলো গণমানুষের ভাগ্যন্নোয়ন। বর্তমান সময়ে দুর্নীতি ও দুবৃত্তায়নের কারনে রাজনীতি যখন নষ্ট হওয়ার পথে, রাজনীতিতে আদর্শ, ত্যাগ ও নিষ্ঠা যখন কমে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে পীর হবিবুর রহমানদের চর্চা করা খুবই প্রয়োজন। কারন রাজনীতির এই ক্রান্তিকালে নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের এটিই তুলে ধরতে হবে যে, পীর হবিবুর রহমানদের রাজনীতিই হলো আসল রাজনীতি, শুদ্ধ রাজনীতি। স্মরণসভার শিরোনামের প্রশংসা করে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘রাজনীতির শুদ্ধ পুরুষ’ শিরোনামটি পীর হবিবুর রহমানের জন্য শতভাগ মানানসই, এমন শুদ্ধ পুরুষ যদি রাজনীতিতে তৈরী করা না যায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকারে ছেয়ে যাবে।

পীর হবিবুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক সুলতান শরীফ বলেন, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে আমাদের আলোকিত রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম উজ্জ্বল বাতি ছিলেন প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে যখন পীর হবিবের মত রাজনীতিককে মন্ত্রী সভায় নিয়ে আসার আকাঙ্খা শুনতাম, তখনই বুঝতাম তিনি কত বড় মাপের নেতা। কিন্তু ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়া সত্বেও বঙ্গবন্ধু নিজ আদর্শের প্রতি অবিচল নির্লোভ এই রাজনীতিককে নিয়ে আসতে পারেননি।

প্রয়াত নেতার রাজনৈতিক অনুসারী এডভোকেট তবারক হোসেইন পীর হবিবুর রহমানকে একজন ক্ষনজন্মা রাজনীতিক আখ্যায়িত করে বলেন, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখন্ডের স্বপ্ন পীর হবিবুর রহমান দেখেছিলেন সেই ৫০ এর দশকেই। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাঁর সে স্বপ্ন সফল হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি পীর হবিবুর রহমানের নিজের লেখা একটি স্মৃতিচারণের কিছু অংশ পড়ে শোনান স্মরণ সভায়।

মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস পীর হবিবুর রহমানকে নিজের রাজনৈতিক শিক্ষক আখ্যায়িত করে তাঁর সংস্পর্শে থাকাকালীন কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তাঁর বক্তৃতায়। তিনি বলেন, বিভক্ত ন্যাপ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন পীর হবিবুর রহমান। তাঁর বিশ্বাস ছিলো সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ বলেন, সেই চল্লিশের দশকে ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন পীর হবিবুর রহমান, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই রাজনীতি ত্যাগ করেননি তিনি। 

সাবেক ছাত্রনেতা রুহুল কুদ্দুস বাবুল পীর হবিবুর রহমানের মৃত্যুর কয়েকঘন্টা আগের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মৃত্যুর কয়েকঘন্টা আগে হাসপাতালে দেখতে গেলে প্রয়াত নেতা আমাকে বলেছিলেন, তুমি এখানে কেন? যাও মানুষের কাছে যাও, ঐক্যের কথা বলো।’

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হরমুজ আলী পীর হবিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করলেও পীর হবিবুর রহমানের নামে শ্রদ্ধায় নত হই। কারন, বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশ্যে রাজনীতি করতেন, পীর হবিবুর রহমানের রাজনীতিও সেই একই উদ্দেশ্যে। বাঙালী জাতীর ভাগ্যন্নোয়নের স্বপ্নে বিভোর এই দুই নেতার রাজনীতির মধ্যে কোন সংঘাত আমি দেখিনা। এই দুই রাজনীতি ছিলো একটি আরেকটি পরিপূরক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আর পীর হবিব শুধু দুজন রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন ঘনিষ্ট বন্ধুও। বঙ্গবন্ধুর সংগঠন আওয়ামী লীগের এক সময়ের সিলেট জেলা সম্পাদকও ছিলেন পীর হবিবুর রহমান। সুতরাং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালীর আজ যতটুকু অর্জন, এরজন্য পীর হবিবুর রহমানের কৃতিত্ব কম নয়। সেদিক থেকে সারা রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও পীর হবিবুর রহমানকে আমি একজন সফল রাজনীতিক হিসেবেই তুলে ধরতে চাই।

পীর হবিবুর রহমানের আজীবনের বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী প্রয়াত জননেতা আব্দুল হামিদের ছেলে এম এ মান্নান বলেন, মৃত্যুর আগেও উনার শেষ কথা ছিলো আমি এই দেশ কার কাছে রেখে যাবো।

স্মরণ সভার অন্যান্য বক্তা বলেন, ধর্মীয় পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র হয়েও পীর হবিব ছিলেন ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিশুদ্ধ এই জননেতা সততা, নৈতিকতা, তীব্র পরিমিতিজ্ঞান এবং রুচি ও শালীনতা চর্চার দিক থেকে ছিলেন একজন আপাদমস্তক শুদ্ধ রাজনীতিবিদ। তারা  বলেন, অহংবোধ, আত্মপ্রচার, লোভ ও স্বার্থসিদ্ধি, সাধারণ মানুষের প্রতি মমতাহীনতা-এসব থেকে মুক্ত থাকার সাধণা আমৃত্যু করে গেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই জননেতা। বক্তারা বলেন, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে বিগত যুগের এই রাজনৈতিক আলেখ্য শিক্ষনীয় ও প্রেরণার উৎস হলে জাতী হিসেবে আমরা লাভবান হবো, সার্থক হবে পীর হবিবের আজীবনের শ্রম সাধণাও।তাদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পীর হবিবের মত রাজনীতিক যত বেশি তৈরী হবে, রাজনীতির গুনগত পরিবর্তনও হবে তত দ্রুত। আর এমনটি হলে ‘পীর’ বংশে জন্ম নিয়েও ধর্মান্ধতা ও কুপমন্ডুকতা বিরোধী সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠা পীর হবিবুর রহমান হয়তো-বা অলক্ষ্যে থেকেই তখন আনন্দিত হবেন, হবেন উদ্দীপ্ত।

You might also like