মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ: গুলজার আহমেদ ছিলেন স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম কুশিলব
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট সত্যবাণী
লন্ডন: ষাটের দশকের কিংবদন্তী ছাত্রনেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক গুলজার আহমেদ ছিলেন একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারিগর। এই মহান কর্মকান্ডের জন্য সরকারী সীলমোহরকৃত কোন কাগুজে সার্টিফিকেট না পেলেও মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের স্মরণ ও স্মৃতিতর্পন থেকে বারবার উচ্চারিত তাঁর এই নাম অবশ্যই খুঁজে নেবে ইতিহাস নিজের প্রয়োজনেই। আর এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
গুলজার আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল স্মরণসভায় এমন মন্তব্য করেছেন প্রয়াত এই মু্ক্তিযোদ্ধা রাজনীতিকের এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, হাতেগড়া কর্মী ও অনুসারীরা।
২৬ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভায় সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রয়াত নেতার রাজনৈতিক অনুসারী ও সুহৃদরা। প্রধান অতিথি হিসেবে গুলজার আহমেদকে নিয়ে স্মৃতি তর্পণ করেন তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীল রাজনীতির সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিক, ঐক্যন্যাপ সভাপতি জাতীয় নেতা পংকজ ভট্টাচার্য। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সুপরিচিত আইনজীবী, প্রয়াত গুলজার আহমেদের এক সময়ের রাজনৈতিক অনুসারী এডভোকেট তবারক হোসেইনের সভাপতিত্বে ও সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন প্রয়াত নেতার এক সময়ের রাজনৈতিক অনুসারী সৈয়দ রকিব (লন্ডন)। সংযুক্ত হয়েছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিষ্টার আরশ আলী (বাংলাদেশ), রফিকুর রহমান লজু (সিলেট), অধ্যাপক সৈয়দ মুজিবুর রহমান (যুক্তরাষ্ট্র), মাহমুদ এ রউফ (লন্ডন), হাবিব রহমান (লন্ডন), আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান গৌস সুলতান (লন্ডন), সুব্রত বিশ্বাস (নিউইয়র্ক), ঐক্যনাপের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুল মোনায়েম নেহরু (ঢাকা), সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী বেগম বিলকিস সর্দার (যুক্তরাষ্ট্র), জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জগলুল পাশা (ঢাকা), ডাঃ এনামুল চৌধুরী (যুক্তরাষ্ট্র), আব্দুল ওদুদ চৌধুরী (যুক্তরাষ্ট্র), লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ (কানাডা), ডা: মানস কান্তি দাস (যুক্তরাষ্ট্র), মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ও লন্ডন বাংলাদেশ হাই কমিশনের সাবেক প্রেস মিনিষ্টার আবু মুসা হাসান (লন্ডন), কাশেম আলী (যুক্তরাষ্ট্র), যুক্তরাজ উদীচী সভাপতি হারুনুর রশীদ (লন্ডন), যুক্তরাজ্য সিপিবি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সাবেক ছাত্রনেতা রুহুল কুদ্দুস বাবুল (সিলেট), রাহেলা বেগম (যুক্তরাষ্ট্র), বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আমান উদ্দিন (লন্ডন), এম এ মান্নান (লন্ডন), প্রয়াত গুলজার আহমেদের দুই মেয়ে ফাহমিদা পপি হক ( যুক্তরাষ্ট্র) ও ফারজানা সুপি (ঢাকা), প্রবীন সাংবাদিক বাহাউদ্দিন আহমদ (যুক্তরাষ্ট্র), দৈনিক প্রথম আলো’র উত্তর আমেরিকা বুরো চীফ সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, ডা: আবুল খান সামাদ (যুক্তরাষ্ট্র), সাবেক ছাত্রনেতা ব্যারিষ্টার সৈয়দ আবু আকবর ইকবাল লন্ডন), সত্যব্রত দাশ স্বপন (লন্ডন) ও সাবেক ছাত্রনেতা সৈয়দ হাসান (লন্ডন) প্রমূখ।
বক্তারা তাদের স্মৃতিচারণে প্রয়াত গুলজার আহমেদকে সমাজ প্রগতি আন্দোলনের কর্মী তৈরীর একজন শীর্ষ কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, তাঁর হাতে গড়া অনেক রাজনৈতিক কর্মী এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পংকজ ভট্টাচার্য গুলজার আহমেদকে ইতিহাসের নায়ক আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি ছিলেন একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম কুশিলব। ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচন্ড জনপ্রিয় এই রাজনীতিককে আমি কাছ থেকে দেখেছি, কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর সাথে। কর্মীবান্ধব এই রাজনীতিক ছিলেন আত্মপ্রচার বিমূখ, সংকটে সমাধান বের করতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রয়াত নেতার রাজনৈতিক সহকর্মী ও অনুসারীদের এমন একটি স্মরণসভায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করায় উদ্যাক্তাদের ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা ঐতিহাসিক একটি কাজ করলেন, বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের এক প্রচারবিমূখ কুশিলবকে মৃত্যুর এক বছর পর হলেও আমাদের সম্মান জানানোর সুযোগ করে দিলেন’।
গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রিয় সভাপতি ব্যারিষ্টার আরশ আলী বলেন, ‘গুলজার আহমদ শুধু ব্যক্তি নন, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরী হয়েছে প্রগতিশীল রাজনীতির অগনিত নেতাকর্মী।’
প্রয়াত এই নেতার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী রফিকুর রহমান লজু বলেন, ‘গুলজার আহমদ বৃহত্তর সিলেটের নেতা হলেও, তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনীতির অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ষাটের দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির এক সদস্য ছিলেন গুলজার আহমেদ। কমিটির বাকী দুই সদস্য ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও আহমেদ জামান।’ তিনি জানান, সারা দেশের প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের মধ্যে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। এ বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে রফিকুর রহমান লজু বলেন, ‘৬৪ সালে আমি ও গুলজার ভাই ডিগ্রী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর ৬৬ সালে আবার পরীক্ষা দিতে চাইলে এমসি কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সলমান চৌধুরী আমাদের সেই সুযোগ দিতে রাজি হলেন না। বাধ্য হয়ে আমরা ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এ কে এম হায়দারের তত্বাবধানে সেখান থেকে পরীক্ষা দেই। ঐসময় ফরিদপুর যাওয়ার পর গুলজার আহমেদ ফরিদপুর এসেছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাকে দেখতে জড়ো হতে থাকে। পরে নেতাকর্মীদের চাপে বাধ্য হয়ে গুলজার ভাইকে সেখানে একটি বিশাল সংবর্ধণা নিতে হয়, যে স্টেইজে আমিও ছিলাম তাঁর সাথে’।
ঐক্যন্যাপের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুল মোনায়েম নেহরু নিজেকে গুলজার আহমেদের হাতেগড়া কর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি ও গুলজার ভাই এক সাথেই ছিলাম। ঐসময় মেঘালয়ের বালাটের মইলাম ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্য ছিলেন তিনি, যে ক্যাম্পে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেয়া হতো।’ মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা না দেয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে জনাব নেহরু বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করলেন যে নেতা, কাগুজে সার্টিফিকেটের অজুহাতে বাঙালীর অন্যতম শ্রেষ্ট সেই সন্তানকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রিয় মর্যাদা দেয়া হলোনা, এরচেয়ে বড় লজ্জা আর আমাদের জন্য কি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ প্রেমিকরা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির লোভে দেশের সেবা করেন না। গুলজার ভাইও এইসব স্বীকৃতির ধার ধারতেন না বলেই জীবিত থাকাকালীন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন মনে করেননি। তবে রাষ্ট্র ও আমাদের এটি বুঝা উচিত ছিলো চিনা ভামনদের পৈতার দরকার হয়না’।
গুলজার আহমেদের মেয়ে ফাহমিদা পপি হক নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক একজন দেশপ্রেমিক পিতার গর্বিত সন্তান আখ্যায়িত করে বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি বাবার যেমন ছিলো দরদ ও দায়বদ্ধতা, ঠিক তেমনি পরিবারের প্রতিও ছিলো তাঁর তেমন দায়িত্বপরায়নতা। আর একারনেই আমরা তিন ভাইবোন আজ আজকের পর্যায়ে আসতে পেরেছি। তিনি এসময় তাঁর মা ও বাবার আজীবন মধুর সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেন।দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও অনুসারীদের মূখে পিতার গৌরবগাঁথার কথা শুনে তিনি আবেগাপ্লুত, এমন মন্তব্য করে পপি বলেন, এমন বাবার সন্তান হওয়ার সৌভাগ্য ক’জনের হয় আপনারাই বলুন? আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়েছে, জীবনে এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ তিনি তাঁর বাবা ও মায়ের আত্মার শান্তির জন্য সবাইকে প্রার্থনা করার অনুরোধ জানান।
স্মরণসভার কোন কোন বক্তা শেষ সময়ে গুলজার আহমেদের বিএনপিতে যোগদানের বিষয়টিও বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেন। তাদের কেউ কেউ বলেন, স্বাধীনতার পর সংসদীয় রাজনীতিতে পার্টি গুলজার আহমেদকে প্রকৃত মূল্যায়ন করেনি। আর একারনেই তাঁর মধ্যে একটি অভিমান কাজ করছিলো। তবে তিনি যে আদর্শ বিচ্যুত হননি এর প্রমান পরবর্তীতে তাঁর স্বেচ্চা নির্বাসন।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিসর্জন ও আত্মত্যাগ, গুলজার আহমেদের বিএনপি’র এমপি হওয়াকে এমন ভাবেও মূল্যায়ন করেন কেউ কেউ। ৯৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আওয়ামী লীগের লাগাতার সংসদ বর্জন ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধনের জন্য বিএনপি’র একতরফা নির্বাচনে গুলজার আহমেদের এমপি হওয়াকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নিজের রাজনৈতিক আত্মত্যাগ’ বলে মন্তব্য করেন কোন কোন বক্তা। তারা বলেন, এটি একটি বড় আত্মত্যাগ, এমনটি বুঝেও তিনি আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন বলে শেষ জীবনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
উল্লেখ্য যে, প্রয়াত নেতা জনাব গুলজার আহমদ ১৯৩৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার হাতিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।
সুনামগন্জ জেলার জগন্নাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই তাঁর ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ঐসময় তিনি স্কুল ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হলে কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য তার স্কুলের দু’জন শিক্ষকের নজরে পড়েন তিনি। তাঁরা তাকে কমিউনিষ্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে তিনি কমিউনিষ্ট নেতা রাধা রঞ্জনদের সংস্পর্শে এসে পার্টির আদর্শে দীক্ষিত হন এবং তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার স্কুল গুলোতে ছাত্রদের সংগঠিত করেন এবং মহকুমা পর্যায়ের ছাত্র নেতায় পরিনত হন।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে তিনি নির্বাচনী কাজে সুনামগঞ্জ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে এসে তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টি ও আওয়ামীলীগ নেতা লীলা শরদিন্দু দে, বারীন দত্ত, নূরুর রহমান,পীর হাবিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচিত হন এবং জাতীয় রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। নির্বাচন শেষে তিনি রাজনৈতিক কাজে আত্ম নিয়োগ করার জন্য সুনামগঞ্জ শহরে চলে আসেন এবং পার্টির নির্দেশে সরাসরি আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে নিয়ে কাজ করে সুনামগঞ্জ মহকুমা পর্যায়ের নেতায় পরিনত হন। উল্লেখ্য তখন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যরা আওয়ামীলীগের মধ্যে থেকে কাজ করতেন।
১৯৫৬ সালে গুলজার আহমেদ প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। পরে তিনি সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন এবং সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে তৎকালীন সরকারী (মুসলিমলীগ) আদেশে তিনি ও সত্যব্রত দাস কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন। ফলে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে আর আই, এ পরীক্ষা দেয়া হয়নি তাঁর।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারী হলে তিনি গ্রেফতার হন।ঐসময় কারাগার থেকে পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি পাশ করেন।
এরপর শুরু হয় তার সিলেট জীবন। ১৯৬৩ সালে তিনি এম সি কলেজে ভর্তি হন এবং আবার ছাত্র রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। তার মধুর ব্যবহারে অল্প সময়ে তিনি এম সি কলেজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল ছাত্রের হাতে তাকে দৈহিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এজন্য তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রতিশোধ নিতে তাদের বারণ করেন। ফলে তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে সিলেটে সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন সংগঠনে অত্যন্ত বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন গুলজার আহমেদ। সে সময় তার সাথে ছিলেন ইকবাল আহমদ চৌধুরী, শামসুল আলম চৌধুরী, আব্দুর লতিফ সরদার, আইয়ুব আলীসহ আরো অনেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। ছাত্র লীগ থেকে ছিলেন দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল, ডাঃ হারিছ আলীসহ অনেকে।
রাজনীতিতে বেশী সক্রিয় থাকায় ১৯৬৪ সালে তিনি বি, এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হলে ১৯৬৬ সালে তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বি, এ পাশ করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন তবে কোন পরীক্ষা দেন নি।
১৯৬৬-৬৯ সালে ঢাকা ছেড়ে সিলেটে চলে আসেন গুলজার আহমেদ এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ঐসময় তিনি সিলেট সদর মহকুমা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় সিলেট জেলা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারন সম্পাদক ছিলেন জননেতা তারা মিয়া।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে গুলজার আহমেদের ছিলো নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মেঘালয়ের “বালাট ইয়থ” ক্যাম্পের প্রধান হিসাবে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৯৭২-১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সিলেট জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে ন্যাপ বিভক্ত হয়ে পড়লেও তিনি ন্যাপেই ছিলেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বিএনপি তে যোগদান করেন এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফ্রেব্রুয়ারী ভোটার বিহীন নির্বাচনে অংশ নেন এবং সংসদ সদস্য হন। সে সংসদ ভেঙ্গে গেলে গুলজার আহমদ রাজনীতি থেকে হাত গুটিয়ে ফেলেন এবং আমৃত্যু স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান।
২০১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। তার দু’দিন আগে তার স্ত্রী ও পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। গুলজার আহমদ অসাধারন একজন সংগঠক ছিলেন। শ্রেণী, পেশা, বয়স নির্বিশেষে সবার সাথে মিশতে পারতেন তিনি, কথা বলে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীর শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম এমন একজন বড়মাপের নেতা ছিলেন তিনি।