যশোরে পুড়ে যাওয়া হোটেলে লুটপাট, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৪

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী 

যশোর: যশোর শহরের চিত্রা মোড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা বিশিষ্ট জাবির ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল। একদিন আগেও হোটেল ভবনটির গ্লাস আর অ্যালুমিনিয়ামের পাতের বহিরাবরক চকচক করছিল। অথচ আজ সেই ভবনটির অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু নেই।  

অগ্নিসংযোগের পর লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেলের ভেতরে পুড়ে যাওয়া বালিশ, কাঁথা, বিছানা, চাদর থেকে শুরু করে বিলাসবহুল সব জিনিসপত্র।

 

এমনকি মঙ্গলবার (০৬ আগস্ট) দুপুর ২টা পর্যন্তও লুটপাট করতে দেখা গেছে। যে যেভাবে পারছেন জিনিসপত্র ভেঙে খুলে নিয়ে যাচ্ছেন।

 

 

বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালের মালিক যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।  

 

তিনি যশোর -৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্যও ছিলেন।

 

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়ার পর সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যশোর শহরে মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। ওই মিছিল থেকে বিক্ষুব্ধ লোকজন চিত্রা মোড়ে অবস্থিত হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর শুরু করে। দ্বিতীয় দফায় বিকেল ৪টার দিকে লোকজন সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার এক নাগরিকও আছেন। আহত হয়েছেন ২৩ জন। হোটেলে তৃতীয় তলার মদের বার থেকে কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। লুটপাটের সময় সেখানে আটকা পড়ে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।  

 


যশোর জেনারেল হাসপাতাল ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহতদের বেশির ভাগ আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের সময় অনেকেই কৌতূহলবশত অগ্নিসংযোগকারীদের সঙ্গে হোটেলে প্রবেশ করেন। প্রায় দুই শতাধিক আন্দোলনকারীরা হোটেলটির বেজমেন্টে ঢুকেই সিঁড়ি বেয়ে ১৪ তলা পর্যন্ত উঠে যায়।

এক পর্যায়ে নিচে থাকা বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন যুবক পেট্রোল দিয়ে আগুন দিতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তারা কয়েকটি তলাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দাউ দাউ করে পুরো ১৪ তলাই কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্বলতে থাকে। এতে উপরে থাকা বেশির ভাগ আন্দোলনকারীরা বের হতে পারেনি। ফলে আগুনের ধোয়ায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আটকে থেকে তারা মারা গেছে। তবে কতজন আন্দোলনকারী, বা হোটেলটির অতিথি, কর্মকর্তা, কর্মচারী মারা গেছে সেটা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি। যার কারণ হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালে মরদেহ এলেই স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে গেছে।  

পুলিশ প্রশাসন মাঠে না থাকাতে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে নিহতের নাম ঠিকানা তালিকা করেই মরদেহ হস্তান্তর করেছেন। আর আহতদের খুলনা ও ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে।
যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ পরিচালক দেওয়ান সোহেল রানা বলেন, ‘জাবির হোটেলে আগুন লাগার খবর পায় ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে। এর পর গাড়ি নিয়ে বের হতে গেলে দেখি আমাদের গেটের সামনে আন্দোলকারীরা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের বের হতে দেবে না। এর কিছুক্ষণ পরেই আবার তারাই আমাদের বলে দ্রুত চলেন হোটেলের ভেতরে আমাদের লোকজন আটকে গেছে। তাদের বাঁচাতে হবে। হোটেলের কাছে গিয়ে দেখি পুরো হোটেল জ্বলছে। পরে জেলার আরও পাঁচটি স্টেশন ও খুলনার একটি স্টেশন দিয়ে ৭ ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি।

এ ঘটনায় হোটেল থেকে আমরা ২৪টা মরদেহ উদ্ধার করেছি। দুইজনকে হেলিকপ্টার দিয়ে আহত অবস্থায় উদ্ধার করি। তিনি বলেন, কি দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেটা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। হোটেলে নিজস্ব অটোমেটিক অগ্নিনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকলেও আগুন লেগে অকেজো হওয়াতে সেগুলো কাজ করেনি। এছাড়া হোটেলে বেশি ডেকোরেশন করাতে আগুন বেশি ছড়িয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেশির ভাগ মানুষকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। মরদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৩ জন। তাদের বেশিরভাগের শরীরের ৩০ ভাগ পুড়ে যাওয়াতে খুলনা ও ঢাকাতে রেফার্ড করা হয়েছে। নিহত বিদেশি নাগরিকের বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ার অ্যাম্বাসি থেকে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।

শাহীন চাকলাদারের হোটেল ছাড়াও শহরের কাজীপাড়া কাঠালতলাস্থ তার বাসভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।  

এছাড়া তার চাচাতো ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টুর বাসভবন, সদরের মালঞ্চিতে চাঁদ ফুড ও ডিমের কারখানাতে লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। শহরের গরীবশাহ সড়কে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য, চারখাম্বা মোড়ে অবস্থিত শেখ রাসেলের ভাস্কর্যও ভাঙচুর করা হয়েছে।

চাঁচড়া মোড়ে যশোর-১ আসনের সংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। জেলার আট উপজেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতেও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটের ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো এলাকায় গরু-ছাগল লুট করে রাতভর বনভোজনের আয়োজন করে সুবিধাবাদী দুর্বৃত্তরা। 

You might also like