যাদুকাটা নদীতে বালু উত্তোলন করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন লক্ষাধিক শ্রমিক
শামীম আহমদ তালুকদার
সত্যবাণী
সুনামগঞ্জ থেকেঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপার লীলাভূমি রুপের রানী প্রাকৃতিক উপায়ে ভারত থেকে আসা বালু পাথর সম্পদের আঁধার সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী যাদুকাটা নদী।এ নদীকে ঘিরেই হাওরপাড়ের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন জীবিকা ও আয় রোজগারের মধ্যেমে গড়ে উঠেছে তাদের সুন্দর পথচলা। এই নদীকে ঘিরে হাওরপাড়ের বেকার শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করার পাশাপাশি তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে পাঠানোর একটি সুযোগও এই নদী। দীর্ঘদিন আইনি জটিলতা ও উচ্চ আদালতে মামলাজনিত কারণে ইজারা বন্দোবস্ত না হওয়ায় এই রূপের নদী যাদুকাটায় কাজ হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন লাখো শ্রমজীবী মানুষ।দীর্ঘ প্রায় ২ বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে খুলে দেয়া হয় বালু মহাল যাদুকাটা।
জানা যায়, গত ১২ জুন থেকে শ্রমিকেরা জীবন জীবিকা ও আয় রোজগারের আশায় কোমড় বেঁধে নদীতে প্রতিদিন নেমে তুলছেন বালু। তাদের এই কষ্টার্জিত বালু উত্তোলন করে তা বিক্রি করে দুবেলা দুমুঠো ভাতর জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে পারায় তারা বেজায় খুশী। হাতের সাহায্যে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বালু উত্তোলন করছেন প্রায় ৫০ হাজারের অধিক শ্রমিক। দিন শেষে হাজার পনেরশ’ টাকা নিয়ে চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যসামগ্রী খরিদ করে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরেন তারা। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে আনন্দের সীমা নেই শ্রমিকের মনে। যেন যাদুকাটা নদীতে ফিরেছে শ্রমিকের প্রাণ ।
সীমান্তবর্মী ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশের নদীটির কাছে উচু উচু পাহাড়কে ঘিরে হাওরপাড়ের মানুষের বসবাস। প্রতিটি দিন প্রকৃতি নানান রুপে আকাশকে কখনো মেঘাচ্ছন করে কখনো প্রচন্ড রোদের কড়তাপে মনে হয় আকাশ হেলান দিয়েছে পাহাড়ে। ভারতের এই পাহাড় দিয়ে ঝর্ণার পানি গড়িয়ে তা পড়ছে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের সীমানা যাদুকাটা নদীতে। পাশেই রয়েছে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বিখ্যাত শিমুল বাগান, এরপাশে রয়েছে বারিকটিলা এটি লাউড়েরগড় এলাকার অংশ। এখানকার বয়ে চলছে যাদুকাটা-১। এই এলাকাকে যাদুকাটা-২ নামে মহালের ভাগ করা হয়েছে। নদীতে প্রাকৃতিক সম্পদ বালু আর পাথর। বিশ্বের উন্নতমানের বালু এখানেই মিলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বালু ও পাথর ব্যবসায়ীরা বালু ও পাথর কিনতে এই যাদুকাটায় আগমন ঘটে। অনিন্দ সুন্দর এ নদীর দিকে চোখ মেলে থাকান আগত পর্যটকরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা সৌন্দর্য্য উপভোগ আর বালু উত্তোলনের উৎসব দেখে বেলা কেটে যায় তাদের।
স্থাানীয় সুত্র জানায়, হাজার হাজার শ্রমিক ছোট নৌকায় করে নদীতে নেমে নিজ প্রচেষ্টায় বালু উত্তোলন করছেন। এসব বালু নগদ টাকায় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। শ্রমিকের কলরবে মুখরিত এই যাদুকাটা নদীর মোহনা। প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক ফিরে পেয়েছেন কর্মসংস্থান। প্রতিজন শ্রমিক হাজার পনেরশ’ টাকা করে আয় করছেন। দুপুর বেলার খাবারও সেরে ফেলেন নদীতে। হাসিতে খুশিতে বিকাল হলেই ফিরেন বাড়ি। তাদের চোখে মুখে এখন আর নেই কোন হতাশার ছাপ। বরং স্বপ্ন দেখছেন নদীকে ঘিরে। শ্রমিকের সাথে নৌকার মালিক, ব্যবসায়ীসহ অসংখ্য লোক আয় করছেন নদীর উপর নির্ভর করে। এবং নদীর আশপাশ এলাকার বাজারগুলোতে বিকিকিনি বাড়ছে। আগের চেয়ে ৫০গুন বেশী বিকি বাড়ছে দোকানগুলোতে। সন্ধ্যা হলেই বাজারে মাছ, মাংস ইচ্ছেমত কিনছেন শ্রমিকরা। বাজারে পণ্যের দামও বাড়ছে। এসব গায়ে মাখেন না শ্রমিকরা। এভাবেই এলাকায় অর্থনীতি সচল হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মিয়ারচরের শ্রমিক শুকুর আলীর জানান, করোনা ও নদী বন্ধ থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে খুব কষ্টে ছিলাম। ইচ্ছে ছিল বাড়ি ছেড়ে পালাই। নদী খুলে যাওয়ায় কোথাও যেতে হয়নি। নদীতেই বালু উত্তোলন করে হাজার পনেরশ’ টাকা আয় করতে পারি। পরিবার পরিজন নিয়ে খুশিতে দিন কাটছে বলে তিনি জানান।
ঘাগটিয়া গ্রামের আলমগীর জানান, নদী বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটিয়েছি। নদী খোলার পর পরিবার পরিজন নিয়ে সুখেই আছি। লামারচর গ্রামের ছামাদ বলেন, আমাদের তিন বেলার আহার জুটে এ নদীকে ঘিরে। নদী বন্ধ থাকায় লগ্নি করে সংসারের খরচপাতি করেছি। অনেক দিন পর স্বপ্নের নদী ইজারা হওয়ায় আমি দৈনিক এক হাজার টাকা আয় করছি। আশা করি দেনা পাওনা মিটিয়ে এখন ভালই চলতে পারবো। এ বক্তব্য নদীতে কাজ করেন প্রতিটি শ্রমিকেরেই।এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি ও যাদুকাটা নদীর ইজারাদার সেলিম আহমদ জানান, একটি দুষ্ঠু চক্রের মামলা মোকদ্দমার কারনে এই যাদুকাটার বালু মহাল বন্ধ থাকায় হাওরপাড়ের লাখো শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলেন। আইনী লড়াই শেষে সুপ্রিম কোর্ট আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আমি বৈধ ইজারা প্রাপ্ত হই, এবং নদী থেকে বালু উত্তোলনের আর বাঁধা রইল না। এখন প্রতিদিন প্রায় লাখো শ্রমিকরা তাদের হাতের সাহায্যে বালু উত্তোলন করছেন। দিন শেষে হাজার হাজার পনেরশ’ টাকা নিয়ে মহা ধুমধামে বাড়ি ফিরছেন। কেউ বোমা মেশিন চালাতে পারবেন না সাফ নিষেধ দেওয়া আছে। আমি চাই হাওরের শ্রমিক বাঁচুক। শ্রমিক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রায়হান কবির বলেন, হাওরপাড়ের মানুষের জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম যাদুকাটা নদী। এ নদীতে কাজ করে শ্রমিকেরা আয় করছেন। পরিবেশ বান্ধব উপায়ে কাজ করে শ্রমিকেরা পরিবার পরিজন নিয়ে ভাল থাকুক। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে শ্রমিকেরা অংশ নেওয়ায় সব ধরনের সহযোগীতার আশ্বাস দেন তিনি।এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ইজারাদারদেরকে যাদুকাটা নদীতে বালু উত্তোলনের সীমানা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। যাদুকাটা নদীতে এসে দেখলাম এখানকার শ্রমিকরা নদী থেকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। যারা দীর্ঘদিন বেকার ছিল। শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যতা দেখে খুবই ভালো লাগছে।