সকল বন্ধনের উর্ধ্বে বাবু সুধীর দাস

সুশান্ত দাস(প্রশান্ত)

সত্যবাণী

লন্ডন: কিছু বন্ধন যেমন জন্ম সূত্রে সৃষ্ট হয়ে থাকে আবার কিছু বন্ধন সামাজিকতায়ও সৃষ্টি করে থাকে।আর এসব বন্ধনে রক্তের ভিতরে ও বাহিরে সুধীর দাস রেখে গেছেন স্ত্রী,নাতি,নাতন,ভাই,ভাতিজা,বোন,ভাগ্নে সহ অসংখ্য গুনাগ্রাহী সুধীজন।এসব বন্ধনের সব কিছুর উর্ধ্বে(২৩/১১/২০)চলে গেলেন বাবু সুধীর দাস।কথা বলছিলাম সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লালাবাজারের টেংরা গ্রামের ক্ষিরোদ চন্দ্র দাস ও প্রমিলা বালা দাসের প্রথম সন্তান বাবু সুধীর দাসের কথা।তাঁর জন্ম ১৯৪২ ইংরেজীর ৯ই এপ্রিল ।

সুধীর বাবুর আরো দুই ভাই ও এক বোন আছেন। তিনি ১৩৮৮ বঙ্গাব্দের ১৬জৈষ্ঠ বিয়ে করেন মলিনা রানী দাসকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলেও তখনো আজকের ন্যায় ফাঁক ফোকরে ঘটতো ধর্মান্ধতার নানা ঘটনা।তবে তার মাঝে অনেক ভাল মনের ভাল মানের মানুষও পাওয়া যেতো। এমন সব ঘটনায় ছোট বেলায় ডানপিঠে আচরন করতে মোটেও হাত পা কাঁপতো না,কথাগুলো খুব সাহসের জুড়ে বলতেন। এমন সব ঘটনার বেড়াজালের মধ্যে সুযোগ পান বিলেতে আসার । স্কুলের মাস্টার মশাই মৌলভী স্যারের কাছে বিষয় বৃতান্ত সব খুলে বললে স্যার বললেন দেখো- আমরা সাধারন ঘরের মানুষ,জীবনে সচ্চলতার দরকার তাছাড়া তোমার বা তোমার বাড়ির পেছনে ওরা যেভাবে লেগে আছে আমার মনেহয় তোমার বিদেশ যাওয়ার এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না তাই চলেও এলেন বিদেশে। সাল আনুমানিক ১৯৬২/১৯৬৩। গল্প করতেন এই ভাবে বাবু সুধীর দাস।

গল্প করতেন বিলেতে ১৯৫০-১৯৬০ দশকে আগত আমাদের পূর্বপুরুষরাই আমাদের জন্য ভীত তৈরি করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা পার হয়ে আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। যা তোমাদের মতো এখনের তরুনেরা কল্পনাও করতে পারবে না।শুধু তাই নয় আমরা এসেও দুদোল্যমান অবস্থায় থাকতে হয়েছে। ভাবতে হয়েছে আসছি তো ঠিক, থাকতে পারবো কতদূর? আর এখানের আবহাওয়া,পরিবেশ, সংস্কৃতি দেখলে পরিবার আনার কথাও ভাবতেই পারতাম না। তোমরা আজকে যে ভাবে দেখতে পারছো শৌচাগার(স্নানাগার) তখন তা এ রকম ঘরে ঘরে ছিলো না। ছিল পাবলিকলি। ঘর থেকে স্নানের(গোসল) জন্য যেতে হতো বেশ দূরে।বাবু সুধীর দাসের সাথে আমার পরিচয় হয় ২০১০ সালের শুরুর দিকে বন্ধু বর শ্যামাকান্তর মাধ্যমে। ওর মাধ্যমেই শুরু হয় কাকু ডাকা। তবে আমাদের বাড়িতেও উনার মতো এক কাকা ছিলেন আমরা ডাকতাম পুতু কাকা। নাম হরিপদ দাস সেই সুবাধে উনাকে জানিয়ে আমি কাকু ডাকতাম। এক সময় হয়ে উঠি আদরের। সময়ে অসময়ে,প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হয়ে উঠতো কতো কথার গল্পের ঝুড়ি। বয়সে সন্তান তুল্য হলেও বন্ধুত্বের ন্যায় গড়ে ওঠে সম্পর্কের গভীরতা।

সম্পর্কের গভীরতা বুঝাতে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মুখ খোললেন সাউথপোর্টের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবু জ্যোতির্ময় দাস হীরা। তিনি বলেন বাবু সুধীর দাস ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। উনার সাথে আমার ৪৩ বৎসরের বন্ধুত্ব। উনার সাথে পরিচয় হয় ১৯৭৭/৭৮সালে। আমি উনাকে দাদা হিসাবে সম্বোধন করি। উনিও আমাকে খুব স্নেহ করেন। ১৯৮৫ সালের দিকে হঠাৎ আমার ভীষন টাকার দরকার হয়। তখনো অর্থনৈতিক দৈন্য দশা ছাড়িয়ে উঠতে পারিনি। দাদাকে দিয়ে টাকার পরিমান না লিখে সাইন করে নেই চেক বই। দাদা সুধীর দাসও পরিমানের কথা বলেন নি আমিও বলিনি। এই ছিল দাদা সুধীর দাশের সাথে সম্পর্ক।পরে অবশ্য আমিও উনার প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছি। এই দুখ ভারাক্রান্ত মনে একটু হেঁসে জ্যোতির্ময় বাবু বললেন বাবু সুধীর দাসের সাথে আমার একটা মাজার কাহিনী আছে । জানতে চাইলে উনি বললেন- দাদা বৌদিকে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করলে এয়ারপোর্টে দাদার সাথে বৌদিকে রিসিভ করতে যাই। ইমিগ্রেশন শেষ করে বৌদি বাহির হলে কোশল বিনিময়ের প্রাক্কালে দাদা হতে জানতে চাইলেন কিভাবে এয়ারপোর্টে আসা হয়েছে? দাদা আমাকে আংগুল দেখিয়ে বললেন “ও” ড্রাইভিং করে আসছে। বলতে না বলতে দেখি বৌদি আমাকে দেখিয়ে বলছেন ড্রাইভারকে বলো আমার জন্য একটা “পান” আনতে। দাদা তো বৌদির এমন কথা শুনে আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসছেন আর আমিও দাদার মুখের দিকে চেয়ে হাসলাম। প্রায় গল্পের মাঝেই দাদা-বৌদিকে এ কথাটা উল্লেখ করতাম। দাদা শুধু হাসতেন। আজ সেদিনের হাসি স্মৃতি হয়ে দাঁড়ালো।

কথা হয় অনি দাশের সাথে। বাবু সুধীর দাসের কথা জানতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে কিছুটা বিলাপ করতে থাকেন। তিনি বলেন উনি সম্পর্কে মামা শ্বশুড় হলেও আমার বিয়ের পর থেকে উনাকে দেবতুল্য শ্বশুড় হিসাবে পেয়েছি এবং আমি বাবা বলে ডাকতাম। বলা যায় ভাগ্নাবধূ হিসাবে দেখেন নি বরং মেয়ে হিসাবে-ই দেখেছেন। ১৯৯৬ সালে আমার বিয়ে হলেও ১৯৯৭ হতে বিলেতের ব্রাডফোর্ডে চলে আসি । এক সাথে থাকা হয় দীর্ঘদিন। কিন্তু উনার ভাগ্না মানে আমার স্বামীর কাজের সুবাধে পরে ব্রাডফোর্ড ছেড়ে প্বার্শবর্তী শহর সাউথপোর্টে চলে আসি। প্রতিসপ্তাহে আমরা আসা যাওয়া না করতে পারলেও প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে রয়েছে যোগাযোগ। কিন্তু অতি সাধারনের মতো সেদিন(১৯ নভেম্বর) হসপিটালে গিয়ে আর যে ফিরবেন না তা কল্পনা করতে পারিনা। ভর্তির শুরুতেও জানতাম না অদৃশ্য করোনার আক্রমণ। ভাবছিলাম অন্য সময়ের মতো সাধারন চেকআপ করে ফিরে আসবেন। কিন্তু চোখের সামনেই দেখতে পেলাম পরিবর্তন, মেডিকেল হতে ডাক্তারদের বার বার ফোন। দৌড়ে গেলেও পারিনি ছুঁতে।আবার পারিনি নিজের মনকেও বুঝাতে। নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করি যে মানুষটি ভাগ্না বধূঁ নয় পুত্রবধূর ন্যায় মেয়ে হিসাবে আমাকে ঘরে প্রবেশ করালো আজ উনি নিজের ঘর ছেড়ে বিধায়ের ঘন্টা বাজাচ্ছেন। হায়রে বিধাতা! অবশেষে ব্রাডফোর্ড সিটির রয়েল ইনফার্মারী হসপিটালের ২৩ নভেম্বর বিদায়ের ঘন্টাকে মানতে বাধ্য হলাম।

জানা যায় ৬০ দশকের সময়ে একটু এদিক সেদিক করে যারা বিলেতের ব্রাডফোর্ড-লিডসের শহরের দিকে কাজের জন্যে স্থায়ী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে খোকা বাবু,সুধীর বাবু,রমা বাবু সবাই এক সাথে ম্যাস করে থাকতেন। সপ্তাহের ছুটির দিনে সিনেমা দেখা,তাসখেলা থেকে বিভিন্ন আনন্দফুর্তিতে সময় কাটাতেন। তাঁদের মাঝে খোকা বাবু দেশে শিক্ষক ছিলেন। পড়াশুনায়ও অন্যদের তুলনায় ছিলেন এগিয়ে। কিন্তু বাবু সুধীর দাস ছিলেন সামাজিক পরিচিতিতে ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি তৎকালীন সকল প্রবীণদের তুলনায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে ছিলেন পারদর্শী। ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাটাও বুঝতেন ভালো। সেই হিসাবে তাঁর সমসাময়িক পরিচিত বন্ধুদের পরিবারের অনেক সদস্যকে এদেশে আনতে সহায়তা করেছেন। অনেক প্রয়াত হয়েছে কিন্তু সেই বন্ধুত্বের খাতিরে তাঁদের পরিবারকে খোঁজে খোঁজে বাহির করে এদেশে আসতে করেছেন সহায়তা। ফলশ্রুতিতে কমিউনিটিতে গড়ে উঠেছে রক্তের বন্ধনের চেয়ে বড় বন্ধন। কারো কাছে চাচা,কাকা,জেঠু,মেসো,তাঐ ,নানা বা দাদু সহ বিভিন্ন সম্ভোধনে।

সুধীর বাবু ব্যক্তিগত জীবনে কর্তব্যপরায়ন,সদালাপী,হাস্যবৎসল,
পরোপকারী,সামাজিক,সংগঠক হলেও মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে হয়ে যেতেন খুব অভিমানি। মানুষকে ভালবাসতে পছন্দ করতেন। মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন; পছন্দ করতেন রসনা বিলাস খাবার। ছিলেন বন্ধু পরায়ন আড্ডা প্রিয় মিশুক মানুষ। অতি সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন।তাঁর নিজের সন্তানাদি নেই কিন্তু কর্তব্যের ক্ষেত্রে ভাই ভাতিজি,আত্মীয় অনাত্মীয় থেকে কাউকেই হেরপের করে দেখতেন না। এমনকি বন্ধুবান্ধবের সন্তানদের ক্ষেত্রেও তাই। নিজের জীবনের ভোগ বিলাসের উর্ধ্বে অনেককে করেছেন প্রতিষ্ঠা।

সামাজিক সংগঠক হিসাবে বাবু সধীর দাশ প্রবীণদের মাঝে অন্যতম। এমনই স্মৃতিচারন করতে ব্যবসায়ী জ্যোতির্ময় দাস হীরা আরো বলেন আমার যতোটুকু মনেপড়ে আশির দশকের প্রথমার্ধে বাবু সুধীরদাকে মনীন্দ্র দে,অনন্ত দে উনাদের সাথে দুর্গাপূজার আয়োজনে দেখেছি। আবার পুতুল বৈদ্য,পুর্নেন্দু রায়,বুশ বাবু উনাদের সাথেও পূজার আয়োজনে দেখেছি তবে পূজা কমিটিতে ছিলেন কি-না তা মনে নেই। তবে ‘ব্রাডফোর্ড বেঙ্গলী হিন্দু কালচারাল সোসাইটি’ অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। বলা চলে ঐ সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ব্রাডফোর্ডে দুর্গাপুজার একজন দৃঢ় উদ্যোগক্তা,অন্যতম ও প্রবীন। যদিও পুজা বিভিন্ন দলে উপদলে হয়ে থাকে।

আমরা জানি উনসত্তরের গণ আন্দোলন, আগরতলা মামলা, রাজনৈতিক অবস্থা, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতাসুলভ ব্যবহার এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করার বিষয়সমূহ বিলেত প্রবাসি বাঙ্গালী শ্রমিকদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য শ্রমজীবি মানুষের ন্যায় বাবু সুধীর দাসও ছিলেন উদগ্রীব। ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সবার সাথে বাবু সুধীর দাস পুরো এক সপ্তাহের পূর্ন রোজগার ইউকে মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট জমা করেছিলেন। কথাগুলো স্পিরিট অব সেভেন্টি ওয়ানের অন্যতম উদ্যোগক্তা ও সাংস্কৃতিক কর্মী অমর বৈদ্য হতে জানা যায়। তিনি আরো বলেন ‘ সুধীর বাবু ব্রাডফোর্ডে বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকলেও মাঝে মাঝে রাগে খুব অভিমানী হয়ে যেতেন। দেশমাতৃকারটানে জন্মস্থানে যেতেন বারে বারে। গল্প করতেন সেই ছেলেবেলার গাঁও-গেরামের কথা। দু-এক বার আমার সাথেও গিয়েছেন দেশের সিলেট শহরে। ঘুরে ঘুরে বলতেন বাবারে শ্রীচৈতন্য-শাহপরান-শাহজালালের মাঠির গুন-ই আলাদা। বলতেন মাটির টান বড়ো টান। আরো কতো কি !

৭১এ তিনি এদেশে থাকলেও তাঁর বাড়ির অন্য জনেরা জীবন বাঁচানোর জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে,আসামের গৌহাটির ডিগারু নামক কোন এক পল্লীতে। আত্মীয় স্বজন ও পূর্ব পুরুষদের উছিললায় তাঁরা থেকে যান ঐখানে। পরে উনিও সেখানে গিয়ে মিশে যান একাকার হয়ে। ফলে তাঁদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে এই পল্লীতেই সাধারন মানুষের চলাচলের জন্য দিয়ে গিয়েছেন “সুধীর চন্দ্র দাস পথ” নামের একটি সড়ক।আজ তাঁর দেওয়া পথ দিয়ে মানুষ হাঁটছে,তাঁকে হৃদয় থেকে অনুভব করে আউড়াচ্ছে, কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষজন বিভিন্ন সম্ভেধনে ডাকছে, তাঁর গঠিত অনবদ্য কর্মযজ্ঞ তাঁকে খোঁজছে কিন্তু সকল বন্ধনের উর্ধ্বে বাবু সুধীর দাস।

You might also like