সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়:আউটসোর্সিংয়ে লোকবল সরবরাহে টেন্ডার ছাড়াই বারবার অনুমোদন পায় ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠান

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ দালালরা বলেছিলো সরকারি অফিসে চাকুরি। পদ নিরাপত্তা প্রহরী। ছোট হোক, বড় হোক সরকারি চাকুরি। একবার ঢুকে গেলেই সেই চাকুরি একদিন সরকারি হয়ে যাবে। দালালদের এমন আশ্বাসে তরুণ এনামুল হক সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের এক কর্মচারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এরপর মাস তিনেক যেতে না যেতেই বুঝতে পারেন সরকারি অফিসে চাকুরি করলেও এটা সরকারি নয়, এ যেন রক্তশোষণকারী কোম্পানি। ১২ মাসে বছর হলেও টাকা দেয় ৯ মাসের। টানা ৭ মাস কোন বেতনই দেয়নি। এরপর বছরে বছরে টাকা চায় ওই চক্র। টাকা না দেয়ায় আর চাকুরিতে নেই সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক। শুধু এনামুল হক নয়, দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে চলছেন সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের অধীনে কমর্রত আউট সোর্সিংয়ের ৯৯ জন কর্মচারী। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে এই কর্মচারীদের সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে সিভিল সার্জন অফিসেরই একটি চক্র। সর্বশেষ ওই দালাল চক্র ও সিভিল সার্জন অফিসের কতিপয় কর্মচারী মিলে চলতি অর্থবছরের অনুমোদন পেয়ে হাতিয়ে নিয়েছে অর্ধ কোটি টাকা। নানা বিতর্ক থাকলেও টেন্ডার ছাড়াই সরকার আউট সোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানকে ৩য় বারের মতো অনুমোদন দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়।

সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চক্র। যে চক্র সকল প্রকার ক্রয় কার্যক্রম, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, বিদেশগামী ছাত্রদের স্বাস্থ্য সনদসহ সেবা নিতে আসা লোকজনকে হয়রানি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত, প্রধান সহকারী অরুণ চৌধুরী, অফিস সহকারী রিংকু, ল্যাব এটেনডেন্ট সেলিম মুন্সিসহ বড় একটি চক্র এ অপকর্মে জড়িত।অভিযোগ রয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৯৯ জন আয়া, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ করা হয়। ঢাকার সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লি: নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সেজে আউটসোর্সিংয়ের লোকবল সরবরাহের কাজ ভাগিয়ে নেয় সিলেটের একটি চক্র। তখন চাকুরি দেয়ার কথা বলে এক একজন কর্মচারীর কাছ থেকে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়া হয়। সিভিল সার্জন অফিসের একটি চক্র দালাল লাগিয়ে বেকার তরুণ-তরুণীদের সংগ্রহ করে। এ রকম ৯৯ জনের কাছ থেকে ২/৩ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয় ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। দরপত্রের চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মাসে মাসে কর্মচারিদের বেতন দেয়ার কথা থাকলেও তা নিয়মিত দেয় না। এমনকি টানা ৭ মাস বেতন না দিয়েই কাজ করিয়েছে এসব কর্মচারিকে দিয়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সিভিল সার্জন অফিসে অভিযোগ দেন। এরপরও পুনরায় টেন্ডার আহবান না করে ২০২১-২২ অর্থবছরে আবারও মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। এরই মধ্যে অনেক কর্মচারী বেতন ভাতা না পেয়ে চাকুরি ছেড়ে চলে যায়। এরপর ওই পদটিও পুনরায় আরও কোন কর্মচারির কাছ থেকে ২/৩ লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ করা হয়। সর্বশেষ কোন প্রকার টেন্ডার ছাড়াই ২০২২-২৩ অর্থ বছরের টেন্ডার আহবান ব্যতীত সরকার আউটসোর্সিং নামের বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেয়েই কর্মরত কর্মচারীদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিচ্ছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। মূলত ওই টাকাগুলো ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সার্জন অফিসের সংঘবদ্ধ চক্র হাতিয়ে নেয়।
আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারি সম্প্রতি চাকুরিচ্যুত সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের মনোপাড়া গ্রামের ফখরুল ইসলামের পুত্র এনামুল হক জানান, চাকুরি পাওয়ার আগেই সিভিল সার্জন অফিসের ল্যাব এটেনডেন্ট সেলিম মুন্সীর মাধ্যমে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে যোগদান করেন। সারা বছরে তার বেতন ছিলো প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। সেই টাকাই যেখানে উঠেনি উল্টো বছর যেতে না যেতে অনুমোদনের কথা বলে পুনরায় ৩০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এরপর চলতি বছরের জন্য আবারও টাকা চায়। অথচ টানা ৭ মাস পর্যন্ত বেতন দেয়নি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এনামুল হক জানান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে মামুনুর রশীদ বাবলু পুনরায় ৫০ হাজার টাকা চায়। একপর্যায়ে ৩০ হাজার টাকা চায়। ওই টাকা না দেয়ায় কোন কারণ ছাড়াই তাকে চাকুরি থেকে বাদ দেয়া হয়।

অপরদিকে, সিভিল সার্জন অফিসে জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেসের কার্যসম্পাদন সন্তোষজনক নয়। মাসের পর মাস বেতন ভাতা না দেয়াসহ নানা অভিযোগ উঠে এই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেসের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সেখানকার আউটসোর্সিং এর কর্মচারিরাও তাদের ২০২১-২২ অর্থবছরের জুন মাসের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন। এছাড়া প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রধানরাও বেতন ভাতা না পাওয়া কর্মচারিদের দিয়ে কাজ করাতে গিয়ে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। এতোসব অভিযোগ থাকার পরে পুনরায় টেন্ডার ছাড়া বিতর্কিত সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লি: এর মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন উঠে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ এস এম শাহরিয়ার পবিত্র হজ পালন করতে সৌদি আরবে চলে যান। এই সময়ে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ জন্মেজয় ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেন। সিভিল সার্জন মক্কায় থাকাকালে সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ-এর পক্ষে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। দালালরা আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারিদের কাছ থেকে চাকুরি চলে যাবার ভয় দেখিয়ে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেয়। এরপর স্বাস্থ্য বিভাগের ৩ জন এবং গণপূর্ত ও তথ্য অফিসের ২ কর্মকর্তাকে সদস্য করে দরপত্র প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে। ২৬ জুন বিতর্কিত সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ কে পরের বছরের জন্য অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের জন্য ঢাকায় প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়, পুনরায় টেন্ডার আহবান করলে বন্যা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং সরকার আউটসোর্সিং সিকিউরিটি সার্ভিসের সার্বিক কর্ম সম্পাদনের মান সন্তোষজনক। বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে দরপত্র প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির এমন মন্তব্য বিস্মিত করে স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টদের।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ ঢাকার প্রতিষ্ঠান হলেও সিলেটে রয়েছে একটি চক্র। স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ নেতার নাম ভাঙিয়ে মামনুর রশীদ বাবলু ও জাহাঙ্গীর নামের দুই ব্যক্তি-এই কোম্পানির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন। এরমধ্যে মামনুর রশীদ বাবলু জানান, তিনি সিলেটের পরিচালক। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বাবলু ও জাহাঙ্গীর জানান, প্রথম বছর তারা ৯৯ জন কর্মচারি সরবরাহ করেছিলেন। পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে এর সংখ্যা নেমে আসে ৮৫ জনে। বর্তমানে ৮৫ জন কর্মরত রয়েছেন। তারা জানান, ৮৫ জন কর্মচারির মধ্যে সিভিল সার্জন অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ৩৫ জন কর্মচারি তাদের আত্মীয় স্বজন পরিচয় দিয়ে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে জানা যায়, এদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নেয়া হয়েছে। বাবলু ও জাহাঙ্গীর দাবি করেন এসব কর্মচারিদের নিয়োগ দেয়ার সময় তারা কোন টাকা নেননি। মধ্যখান থেকে দালালরা এসব কর্মচারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকতে পারে। বাবলু ও জাহাঙ্গীর দাবি করেন ২য় দফা মেয়াদে অনুমোদন আনতে টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়। কারণ টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। যার জন্য ৩০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। চলতি বছরও পুনরায় অনুমোদন পেতে খরচ লেগেছে। যার জন্য খরচ বাবদ ৩০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে। তারা দাবি করেন, স্বাস্থ্য বিভাগে টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। তারা নিজেরাও অসহায়।

সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী অরুণ চৌধুরী দাবি করেন, আউটসোর্সিং লোকবল সংক্রান্ত বিষয়টি দেখভাল করেন তারই অফিসের অফিস সহকারী রিংকু। তিনি দাবি করেন, রিংকুই সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লি: এর সাথে যোগাযোগ করেন এবং পুরো বিষয়টি দেখেন।অপরদিকে, রিংকু দাবি করেন আউটসোর্সিং কর্মচারিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এদেরকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাকে কোথায় দায়িত্ব দিবে সবকিছু দেখে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয় বলে তার দাবি।ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: জন্মেজয় দত্ত দাবি করেন, অর্থবছরের শেষ সময় ছিলো। ওই সময়টায় তিনি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের দায়িত্বে। তখন সরকার আউটসোর্সিং এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লি: একটি প্রশাসনিক অনুমোদন নিয়ে আসে। তখন একটি দরপত্র প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি আলোচনার ভিত্তিতে পুনরায় অনুমোদন দেয়ার জন্য সুপারিশ করে। সরকার আউটসোর্সিং এর বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ থাকা সত্ত্বে¡ও তাদের কর্মসম্পাদন সন্তোষজনক উল্লেখ করে অনুমোদনের জন্য সুপারিশের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে তাকে আগে কেউ জানায়নি।সিভিল সার্জন ডাঃ এস এম শাহরিয়ার বলেন, তিনি তখন পবিত্র হজ করতে সৌদি আরবে ছিলেন। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ভুলত্রুটি থাকলে অবশ্য তা বাতিল করার ব্যবস্থা করা হবে। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান লোকবল সরবরাহ করে। এর দায়-দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা: হিমাংশু লাল রায় বলেন, মাসের পর মাস বেতন পায়নি আউটসোর্সিং এর কর্মচারিরা। যেখানেই গেছি অনিয়ম দেখেছি। এরপরও কিভাবে এই প্রতিষ্ঠান পুনরায় অনুমোদন পেল বুঝে উঠতে পারছি না। আউটসোর্সিং এর কর্মচারি নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির দায়ভার সিভিল সার্জনের কার্যালয়কেই নিতে হবে। এরপরও বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান।

You might also like