সিলেটে বহুল আলোচিত ‘সীমান্তের গডফাদার’ ইসমাইল আলী
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ তাকে বলা হয় ‘সীমান্তের গডফাদার’। এক নামেই পরিচিত। ইসমাইল আলী। জৈন্তাপুর উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর ভাই। সাবেক ইউপি সদস্য ছিলেন। সীমান্তের সব কারবারেই উঠে আসে তার নাম। সরাসরিও নিয়ন্ত্রণ করেন চোরাকারবার। সীমান্তের ওপারেও আছে তার বাহিনী। ওপার নিয়ন্ত্রণ করে ওরা, আর এপার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। মূল কাজ হুন্ডি কারবার।চোরাচালানের সব টাকাই পাচার হয় তার হাত ধরে। এ কারণে সীমান্তের সব ধরনের চোলাচালানের নিয়ন্ত্রণও করতে হয় তাকে। সেই ইসমাইল আলী ৩ সঙ্গীসহ রোববার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার হয়েছে র্যাবের হাতে। এরপর থেকে সীমান্তের অপকর্মের নানা কাহিনী রটছে মানুষের মুখে মুখে। জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরবাগ মল্লিপুরের বাসিন্দা ইসমাইল আলী। এ কারণে এক দশক ধরে জৈন্তাপুর সীমান্তের কর্তৃত্ব তাদের হাতে। জৈন্তাপুর থেকে জাফলং পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করেন ইসমাইল। আ’লীগ নেতার ভাই বলে প্রশাসনের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা। বিজিবি- পুলিশের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা তিনি জাহির করেন প্রকাশ্যেই। এজন্য ওই এলাকার চোরাকারবারিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
নিজ এলাকায় ইউপি সদস্য থাকার সময় একতরফা আধিপত্য খাটিয়েছেন। একদিকে ছিলেন ইউপি সদস্য, অন্যদিকে আ’লীগ নেতার ভাই। দু’পরিচয়ে বেপরোয়া হলেও প্রশাসন কখনোই তার ধারে-কাছেও যায়নি। তবে গত ৬ মাস আগে জৈন্তাপুর সদরের একটি ঘটনায় আলোচিত হয়েছিলেন ইসমাইল আলী। একদিন সন্ধ্যায় টমটম আটক করাকে কেন্দ্র করে জৈন্তাপুর উপজেলা সদরে এক ট্রাফিক পুলিশকে প্রকাশ্যে মারধর করেন ইসমাইল আলী। এ ঘটনায় জৈন্তাপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই আটক করে তাকে নিয়ে যায় থানায়। এ খবরে ইসমাইলের সহযোগীরা জৈন্তাপুরে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। সমঝোতায় থানায় ছুটে যান আ’লীগ নেতা লিয়াকত আলী। সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারের আশ্বাস দিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন ভাইকে। এরপর অবশ্য সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারও করা হয়।সর্বশেষ গত রোববার সিলেটের র্যাবের একটি দল জাফলং এলাকায় চোরাকারবারিদের ধরতে অভিযান চালায়। অভিযানকালেই ঘটনাস্থলে উপস্থিতি মেলে ইসমাইল ও তার চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের। র্যাব জাফলং বিজিবি ক্যাম্পের একটি দোকানের পাশের জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এলাকা থেকে বড় অঙ্কের টাকা ভারত পাচার হওয়ার মুহূর্তে গ্রেপ্তার করে মো. জলিল নামের এক চোরাকারবারিকে। গ্রেপ্তারের পর জলিল তার নিয়ন্ত্রক হিসেবে ইসমাইল আলীর নাম প্রকাশ করে। কিন্তু জলিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইসমাইল আলী সঙ্গীদের নিয়ে মামার দোকানে চলে যায়। পরে গ্রেপ্তার হওয়া জলিলের ভাষ্যমতে মামার দোকান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইসমাইল আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই সময় ইসমাইলের সঙ্গে থাকা তারই সহযোগী গোয়াইনঘাটের ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ ও কালিনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. শিপনকে গ্রেপ্তার করে। ৪ জনকে গ্রেপ্তারের পর রাতেই গোয়াইনঘাট থানায় সোপর্দ করা হয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে ইসমাইল গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাফলং ও জৈন্তাপুরের চোরাকারবারিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেকেই চলে যায় আত্মগোপনে।জাফলংয়ের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যখন জলিল গ্রেপ্তার হয় তখন সঙ্গীদের নিয়ে ইসমাইল ওই এলাকাতেই ছিল। পরবর্তীতে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে সে চলে যায়। জলিলকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ১১ লাখ টাকাসহ। সীমান্তের জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এলাকায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। ভারতের ডাউকী থেকে তাদের সহযোগীরা এসে টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই জলিল গ্রেপ্তার হয়।স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রাতের জাফলং হচ্ছে চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্য। তামাবিল থেকে জাফলং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত অন্ততঃ ৫টি স্থান দিয়ে রাতে কোটি কোটি টাকার চোরাকারবার হয়। আর ওই চোরাকাবারিদের নিয়ন্ত্রণ করেন ইসমাইল আলী নিজেই। কারণ চোরাকারবারিদের সব টাকা জাফলং এলাকায় বসে সংগ্রহ করেন তিনি। আর ডাউকীতে বসে নিয়ন্ত্রণ করে ওখানকার একটি চক্র। ওই চক্রের কাছে প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকা পাচার হয় জাফলংয়ের ইসমাইলের হাত ধরে। টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে ভারত থেকে চোরাচালানের নানা পণ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকানো হয়। আবার কখনো কখনো বাংলাদেশ থেকেও পণ্য যায়। এসব পণ্যের টাকা ইমসাইলের মাধ্যমে জাফলংয়ে পরিশোধ করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বছরে ইসমাইলের হাত ধরে অর্ধশত কোটি টাকা পাচার হয় ভারতে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করতে গিয়ে চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন তিনি। সীমান্ত দিয়ে জাফলং প্রবেশ করে কসমেটিকস, প্রসাধনী সামগ্রী, ভারতীয় মদ ও ফেনসিডিল এবং ইয়াবার চালান। রাতের জাফলংয়ে অনেকটা প্রকাশ্যে এসব চালান ঢুকে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।গোয়াইনঘাট থানায় দায়ের করা এজাহারে মামলার বাদী র্যাবের এসআই মনসুর হাল্লাজ জানিয়েছেন, সীমান্তের চোরাকারবারি পণ্যের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতের পাচারের কথা গ্রেপ্তার হওয়া ইসমাইলসহ ৪ আসামি স্বীকার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই টাকা ভারতে পাচারের জন্যই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে জানান তিনি।গোয়াইনঘাট থানার ওসি (তদন্ত) ওমর ফারুক জানিয়েছেন, র্যাবের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ৪ আসামিকে সোমবার সকালে সিলেটের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।এদিকে, জৈন্তাপুরের শেষ সীমানা মোকামপুঞ্জি। চোরাই ব্যবসায়ীদের কাছে বহুল পরিচিত এলাকা। ওখানে রয়েছে আ’লীগ নেতা লিয়াকতের একটি বাংলো। আর ওই বাংলোকে ঘিরেই সেখানকে চোরাকারবারির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন ছোট ভাই ইসমাইল আলী।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ইসমাইল আলীই হচ্ছেন ওখানকার খাসিয়াদের ‘অঘোষিত’ নিয়ন্ত্রক। রাতে তিনি বেশিরভাগ সময় ওখানেই কাটান। চা বাগান ঘেরা ওই পুঞ্জির পেছনের পুরোটা এলাকাই হচ্ছে ভারত সীমান্ত। ফলে রাতের আঁধারে ভারতের ডাউকী এলাকা থেকে অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকের চালান আসে। ইসমাইলের নামে আসা এসব মাদকের চালান পরবর্তীতে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করা হয়ে থাকে। এর বাইরে জৈন্তাপুরের লালাখালসহ একাধিক সীমান্ত দিয়ে রাতের বেলা ঢোকে চোরাই গরু ও মহিষের চালান। এসব চালানের বেশিরভাগ টাকাই ভারতে পাচার করেন ইসমাইল। ডাউকীতে তার অবস্থানও শক্তিশালী। ওখানেও ‘আরএস’ নামে হুন্ডির টাকা পাচারকারী একটি চক্র গড়ে তুলেছেন তিনি। তামাবিল এলাকার আমদানি-রপ্তানীকারক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তারাও মাঝে মধ্যে ইসমাইলের মাধ্যমে টাকা পাচার করেন ডাউকিতে। ওখানেও ইসমাইলের নিয়ন্ত্রিত একটি চক্র রয়েছে। ভিসা ছাড়াই রাতের আঁধারে ইসমাইল ওসব এলাকায় যাতায়াত করেন বলে জানান তারা।
এদিকে, চোরাকারবারি ঘটনার সঙ্গে শুধু ইসমাইলই একা নয়; খোদ তার ছেলে ও ভাতিজা জড়িত। ইতোমধ্যে তারা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করছেন। গত ১৫ই জুলাই সিলেটের শাহ্পরান থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় লিয়াকত আলীর ছেলে জাফর সাদেক জয় আলী, লিয়াকতের ভাই ইসমাঈল আলীর ছেলে আক্তার হোসেন ও গাড়ির ড্রাইভার লিমন মিয়া। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি অত্যাধুনিক প্রিমিও গাড়িও আটক করা হয়। তাদের গাড়ি তল্লাশি করে পাওয়া যায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা ১শ’ দামি মোবাইল ফোন। যার আনুমানিক মূল্য ১২ লাখ ৫১ হাজার টাকা।আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে লিয়াকত আলীর ছেলে জয় স্বীকার করেছে, লিয়াকত আলী তার গাড়িতে করে এই ৩ জনকে দিয়ে মোবাইলগুলো পাঠিয়েছেন সিলেট শহরের করিমউল্লাহ মার্কেটের এক মোবাইল ব্যবসায়ী শিপলুর কাছে হস্তান্তরের জন্য।আটককৃত ৩ জনসহ ৪ জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-বি/২৫-ডি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল।