সিলেটে বিএনপি নেতা আফম কামাল ছুরিকাঘাতে খুনঃ ছাত্রদল নেতা আটক
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সিলেটে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন বিএনপি নেতা আফম কামাল। রোববার রাত ৯ টার দিকে নগরির আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আফম কামাল জেলা বিএনপি’র সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রদলের সাবেক প্রচার সম্পাদক। তার বাসা নগরির সুবিদবাজার এলাকায়।ঘটনাস্থল থেকে সিলেট বিমানবন্দর থানার ওসি মাইনুল জাকির বলেন, রোববার রাতে বড়বাজার এলাকায় আফম কামাল নিজের প্রাইভেটকারে বসা ছিলেন। এ সময় মোটর সাইকেলে আসা দু’জন দুর্বৃত্ত তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।নিহতের মরদেহ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি বলেন, ‘আমরা অভিযান চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে রাজু নামে এক ছাত্রদল নেতাকে আটক করেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জড়িত অন্যদেরও গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছি’।
হাসপাতাল থেকে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আবদুল আহাদ খান জামাল বলেন, কে বা কারা তাকে ছুরিকাঘাত করেছে তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। রাজনৈতিক বিরোধ থেকে এ হত্যাকান্ড কী না তাও আমরা নিশ্চিত নই।সিলেটে নিহত আফম কামালের শরীরে ২৩টি আঘাতের চিহ্ন কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রথমেই বুঝতে পারেন নি ঘটনা। তাদের ধারণা হয়েছিলো একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছে প্রাইভেট কার। এতে মোটরসাইকেল আরোহীরা ছিটকে পড়ে যান। এ কারণে প্রত্যক্ষদর্শীরা এগিয়ে এসে মোটরসাইকেলটিকে উদ্ধার করেন। আর ওই সময়েই ঘাতকরা প্রাইভেট কারের ভেতরে ঢুকে সিলেটের বিএনপি নেতা আফম কামালকে কোপায়।এদিকে, মোটরসাইকেল চলে যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেন প্রাইভেট কারটি চলছে না। এ সময় তারা এগিয়ে দেখেন কারের ভেতরে গোঙাচ্ছেন একজন। তারা ধরাধরি করে কামালকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ঘটনার সময়কাল ২ থেকে ৩ মিনিট। ওই সময়ের মধ্যে তারা বিএনপি নেতা আফম কামালকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপানো হয়। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে হামলাকারীরা দ্রুত চলে যায়।
সোমবার দুপুরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিহত কামালের মরদেহের ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্তকালে কামালের শরীরে ২৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরমধ্যে প্রায় সবক’টি আঘাতের চিহ্নই গুরুতর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন তিনি। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ও হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম জানান ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা গেছেন আফম কামাল। তার শরীরের বাম পাশেই সব আঘাতের চিহ্ন। তিনি জানান বাম হাত, বুকের বাম পাশ, বাম পাশের কাঁধের নিচ, পায়ের উরুতে এসব আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এদিকে দুপুরে ময়না তদন্ত শেষে কামালের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় দলীয় নেতারা।
সিলেটে কামাল হত্যায় অংশ নেয় ৫ যুবক
ব্যবসায়িক দ্বন্ধের জের ধরে বিএনপি নেতা আফম কামালকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। আর কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৫ যুবক। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, নিহত বিএনপি নেতার সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্ধের কারণে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলাও হয়েছিল। ওই মামলার ৪ নম্বর আসামি ছিলেন আফম কামাল। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে।প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আফম কামাল প্রাইভেটকারে চালকের আসনে ছিলেন। তাকে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল অনুসরণ করছিল। তাতে ছিলেন তিন যুবক। এদিকে ঘটনাস্থলে আসামাত্র আরেকটি মোটরসাইকেলে করে দুই যুবক সামনে থেকে কামালের গাড়ির গতিরোধ করেন। পরে তার বুকে ও হাতে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা সটকে পড়ে। এরপর গিয়ারে পা পড়া অবস্থায় সিটে পড়েছিলেন কামাল। ফলে গাড়িটি সামনের চাকা মোটরসাইকেলের ওপরে উঠে যায়। প্রথমে লোকজন এটিকে দুর্ঘটনা মনে করলেও পরে বুঝতে পারে যে হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এরপর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ আরও বলেন, হত্যাকা-ের ঘটনায় এরই মধ্যে সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে আটক করা হয়েছে। তাছাড়া নগরির পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মহানগর পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার ওসি খান মোহাম্মদ মাইনুল জাকির বলেন, অভ্যন্তরীণ পূর্ব বিরোধের জের ধরে আফম কামালকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছি। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কামালের মৃত্যুর খবর পেয়েই রোববার রাতে বিএনপি নেতা-কর্মীরা ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জড়ো হন। খুনের ঘটনায় নেতা-কর্মীরা রাত পৌনে ১১টার দিকে নগরিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে মহানগর আ’লীগের প্রতিনিধি সভাস্থলে ভাঙচুর করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিন আগে বিএনপি’র গণসমাবেশ নিয়ে নেতা-কর্মীরা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীমের বাসায় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আফম কামালও ছিলেন। বৈঠক থেকে বিএনপি’র গণসমাবেশের বিষয় নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে বৈঠক অসমাপ্ত রেখে আফম কামালসহ কয়েকজন নেতাকর্মী বেরিয়ে আসেন। এ ঘটনার কারণে হত্যাকা- ঘটেছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।এছাড়া কামাল লাহিন এয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লোকজনকে বিদেশে পাঠানোর কাজেও জড়িত ছিলেন। সেখানে টাকা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে এক ব্যক্তির ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ছিলেন কামালও। এ ঘটনায় গত ২১ অক্টোবর আজিজুর রহমান সম্রাট নামে বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজীর এক ব্যক্তি কোতয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহার নামীয় ৪ নম্বর আসামি ছিলেন আফম কামাল। মামলায় এজাহার নামীয় ১০জনসহ অজ্ঞাত আরো ৫/৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই ঘটনার জেরে হত্যাকা- হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
নগরিতে বিএনপি’র তান্ডব
জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্য সম্পাদক ও সিলেট ল’ কলেজের সাবেক জিএস আফম কামাল হত্যার প্রতিবাদে নগরিতে ভাংচুর ও অস্ত্রসহ মহড়া দিচ্ছে জেলা ও মহানগর ছাত্রদল এবং যুবদল। আফম কামাল হত্যার প্রতিবাদে রাত ১১টার দিকে জেলা ও মহানগর ছাত্রদল এবং যুবদলের নেতা-কর্মীরা দোকানপাট, গাড়ি ভাংচুর করতে দেখা যায়। এছাড়া হাতে লাঠিসোটা নিয়ে অশস্ত্রসহ মহড়া দিতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে তারা মিছিল দিয়ে চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার পয়েন্টের দিকে যেতে থাকেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেন। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।এ ব্যাপারে কোতয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দু’দলকে দু’দিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তান্ডব প্রতিরোধে শক্ত অবস্থান নিলো আ’লীগ
বিএনপি নেতা আফম কামাল খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নগরিতে তান্ডব চালাচ্ছে বিএনপি, যুবদলের ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এরই একপর্যায়ে নগরির কবি নজরুল অডিটোরিয়ামেও ভাংচুর চালায় তারা। রোববার সকাল থেকেই এই অডিটোরিয়ামে নগর আ’লীগের প্রতিনিধি সভা চলছিল। ৭ নভেম্বর সোমবার এখানে জেলা আ’লীগের প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ কারণে জেলা ও মহানগর অডিটোরিয়াম ও আশপাশের এলাকাকে দলীয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দলীয় বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন ও তোরণে সাজিয়ে রেখেছিল। বিএনপি কর্মীরা এসব ভাংচুর করে। খবর পেয়ে সাথে সাথেই যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা সেখানে ছুটে যান। তারা সেখানে অবস্থান করে ভাংচুরকৃত অডিটোরিয়াম পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তারা চৌহাট্টা থেকে আগত বিএনপি’র বিক্ষোভ মিছিলকে ধাওয়া দেন এবং শক্ত প্রতিরোধ গড়ে কাজী নজরুল অডিটোরিয়াম এলাকায় অবস্থান নেন।