সিলেটে হাঁটাচলার স্থান মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ!
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণ এবং শিল্পায়নের ফলে দেশের বড় শহরগুলোয় সহজ গণপরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানের অভাব দিন দিন বেড়েই চলছে। পিছিয়ে নেই বিভাগীয় শহর সিলেটও। এতে করে নাগরিক জীবনে বাড়ছে দুর্ভোগ। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে হেঁটে চলাচল করার মতো নাগরিকবান্ধব সুবিধাও নেই পর্যাপ্ত মাত্রায়।
সম্প্রতি জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর নানা পর্যবেক্ষণে আশঙ্কাজনক চিত্র ফুঁটে উঠেছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সহজ গণপরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানের মতো অপরিহার্য নাগরিক সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়েই নগরায়ন ঘটছে বাংলাদেশে। এদিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের বড় শহর ও শিল্প এলাকাগুলো। এদিকে, শহুরে রাস্তায় নাগরিকদের হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত স্থানের সংস্থান রাখার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই তুলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। দেশের প্রধান শহরগুলোয় ফুটপাত থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বেদখল হয়ে গেছে না হয় যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ফুটপাতগুলোর গঠন বৃদ্ধ, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের চলাচলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করা নেই। কোনো কোনো স্থানে আবার ফুটপাতের মধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিবন্ধকতা, যা সবার চলাচলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশের বড় শহরগুলোয় নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত স্থান ব্যবহারের সুযোগ আরো শোচনীয়।ইউএন হ্যাবিটাটের সূচকের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ স্থান নগরবাসীর ব্যবহারযোগ্য উন্মুক্ত স্থান হিসেবে আছে। বরিশাল শহর এলাকায় নাগরিকদের জন্য ব্যবহৃত উন্মুক্ত স্থান মাত্র ১ শতাংশ। অন্যান্য শহরের মধ্যে বগুড়ায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১ দশমিক ৪, কুমিল্লায় ১ দশমিক ৪, ঢাকায় ১ দশমিক ৩, খুলনায় ১ দশমিক ৬, রাজশাহীতে ২ দশমিক ১। আর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর। নগর দু’টির মোট আয়তনের মধ্যে সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য উন্মুক্ত স্থান রয়েছে যথাক্রমে মাত্র দশমিক ৫ ও দশমিক ৭ শতাংশ।জাতিসংঘের মানববসতি সংস্থার (ইউএন হ্যাবিটাট) ‘ওয়ার্ল্ড সিটিজ রিপোর্ট ২০২২’ প্রতিবেদনে তুলে ধরা এমনই এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, সহজ গণপরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানের সুবিধার দিক থেকে কুমিল্লা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও রাজধানী ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রায় সবই সম্প্রসারণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। জনসাধারণের জন্য সহজ গণপরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানের মতো নাগরিক সুবিধাগুলো এসব শহরের উন্নয়ন ভাবনায় তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। যদিও নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই তুলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।তারা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নগরে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থানের অভাব অনুভূত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। এসব সুবিধার অভাবে নগরগুলোর পরিবেশ যেমন অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে, তেমনি দুর্ভোগের মাত্রাও বেড়েছে নাগরিকদের।গণপরিবহনের সহজপ্রাপ্যতা ও উন্মুক্ত স্থানের পর্যাপ্ততাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতি বছরই নাগরিক সুবিধার সূচক প্রকাশ করছে ইউএন হ্যাবিটাট। সংস্থাটির এ বছরের সূচকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে সহজ গণপরিবহনের সুবিধায় সবচেয়ে পিছিয়ে কুমিল্লা নগরি। এখানে সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার মাত্র ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বাসিন্দা হাঁটার দূরত্বে গণপরিবহনের সুবিধা পাচ্ছে। গাজীপুর ও ময়মনসিংহে এ হার যথাক্রমে ২২ ও ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। রাজধানী ঢাকায় হাঁটার দূরত্বে গণপরিবহন পাচ্ছে ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া বরিশালে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ, বগুড়ায় ৩৭ দশমিক ৪, চট্টগ্রামে ৬২, খুলনায় ৬৮ দশমিক ৩, রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৭ ও সিলেটে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছে।জানা গেছে, দেশের বড় শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা বেশ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে হাঁটার সুযোগ খুব কম। নাগরিকরা চাইলেই হেঁটে গন্তব্যে যেতে পারে না। একটু হাঁটার পর বসার জায়গা, রাস্তায় পানি খাওয়া ইত্যাদি সেবার ব্যবস্থা যদি সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের জন্য রাখতে পারত, তাহলে শহরে গাড়ির পরিমাণ কমত। কার্বন নিঃসরণও কম হতো।
শুধু ঢাকা বা খুলনা নয়, দেশের বড় শহরগুলোর নাগরিকরা একই সমস্যায় ভুগছে। গণপরিবহনের মতো হাঁটার দূরত্বে উন্মুক্ত স্থানের সুবিধার দিক থেকেও সবচেয়ে পিছিয়ে কুমিল্লা ও গাজীপুরের বাসিন্দারা। কুমিল্লা শহরের মাত্র ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও গাজীপুর শহরের মাত্র ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক হাঁটা দূরত্বে উন্মুক্ত স্থানের সুবিধা পাচ্ছে। ময়মনসিংহ শহরের ক্ষেত্রে এ হার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ঢাকার বাসিন্দাদের ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া বরিশালের ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ, বগুড়ার ৭৯ দশমিক ৮, চট্টগ্রামের ৬৪ দশমিক ৮, খুলনার ৬৫ দশমিক ৩, রাজশাহীর ৮৩ দশমিক ৬ ও সিলেটের ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা পাচ্ছে।ওয়ার্ল্ড হ্যাবিটাটের সূচকে খুলনার অবস্থান তুলনামূলক ভালো দেখালেও সেখানকার নাগরিকরাও খুব একটা ভালো নেই। নগরির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. শুভ বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে এখানে গণপরিবহন অপ্রতুল। নেই উল্লেখ করার মতো উন্মুক্ত স্থানও। এমন নগরিতে বসবাসের অভিজ্ঞতা অস্বাস্থ্যকর। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে আছি দীর্ঘদিন। চিকিৎসক নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দিলেও নগরিতে তেমন কোনো সুবিধা নেই। রাস্তায় বেরোলে বাধ্য হয়ে অটোয় চড়তে হয়। হাঁটতে গেলে ভয় হয়, গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যাবে।