সিসিক নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পুড়ছে জাতীয় পার্টি
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে প্রথমবারের মতো মেয়র পদে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। নগর জাতীয় পার্টির আহবায়ক শিল্পপতি নজরুল ইসলাম বাবুলকে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। নাম ঘোষণার পরেই দলের মনোনয়ন নিয়ে কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের রেশ কাটতে না কাটতেই দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য আসে গণমাধ্যমে। যা নিয়ে সিলেটে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। দলের এই প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রয়েছে জাতীয় পার্টি। তবে, দলের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী।দলের একটি সুত্র জানায়, গত ৪ মে সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন্দ্র করে সিলেটসহ ৫টি সিটিতে জাতীয় পার্টি ৫জন মেয়র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। এরমধ্যে সিলেটে দেয়া হয় সিলেট মহানগর জাতীয় পার্টির আহবায়ক শিল্পপতি নজরুল ইসলাম বাবুলকে।এর পরদিন ৫মে নগরির একটি হোটেলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুবুর রহমান চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে কোটি টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এমন অভিযোগ তুলে দলের প্রার্থী মনোনয়ন পুনঃর্বিবেচনার দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সহ-সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছি। ২০১৮ সালে সিলেট-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচন করেছি। বিগত দিনে সিলেটের মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছি। আর সেই তাগিদেই আমি এবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে বছরখানেক আগে থেকেই সিলেটে কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, টাকার কাছে ফিকে হয়ে পড়েছে একজন রাজনীতিকের স্বপ্ন। এবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির টিকিট।তিনি অভিযোগ করে বলেন, নগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও সাবেক সিলেট মহানগর তাঁতীদলের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবুল প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাঙ্গলের মনোনয়নপত্র কিনে এনেছেন। কালো টাকার এই মালিকের কাছে দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হলাম। আমার সঙ্গে যে অন্যায়, অবিচার করা হয়েছে সিলেটবাসী এর বিচার করবে বলে আমার বিশ্বাস।জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়া বাবুলের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, নানা ঘটনায় বিতর্কিত বাবুল ইতোপূর্বে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৯নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হলেও বিপুল ভোটে পরাজিত হন। দলের চেয়ারম্যান এমন একজন মানুষের কাঁধে লাঙ্গল তুলে দিয়ে এরশাদের দ্বিতীয় দূর্গ সিলেটের নেতা-কর্মীদের শুধু অবজ্ঞাই করেননি, অপমানিতও করেছেন। বিএনপি থেকে আগত নজরুল ইসলাম বাবুলকে যখন মহানগর আহ্বায়ক করা হয় তখন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি বাবুলকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটি বিলুপ্ত করারও দাবি জানানো হয়। কিন্তু দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের সিলেটের নেতাকর্মীদের সেই দাবি না শোনে ওই বাবুলকে এখন লাঙ্গল প্রতীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে উল্টো পুরস্কৃত করেছেন। এতে সিলেটে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদেও মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।তবে, এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, মাহবুবুর রহমান আমেরিকায় থাকেন। সিলেটে এবং দলে তিনি সক্রিয় নন। দলকে দুর্বল করতেই তিনি এসব মিথ্যে অভিযোগ আনছেন।
টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বাবুল বলেন, জাতীয় পার্টি একটি সুসংগঠিত ও বড় দল। এখানে এমন সুযোগ নেই। মাঠে যে শক্তিশালী তাকেই মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাঁটা গায়ে লবন ছিটালেন সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী।গত ১২ মে শুক্রবার নগরির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী।ওই সভায় ইয়াহ্ইয়া বলেন, দল-মত নির্বিশেষে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করে সিলেটের উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানকে বিজয়ী করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।তাঁর এমন বক্তব্যে নাখোশ সিলেট সিটিতে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। তিনি দলের চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করেছেন বলে শনিবার গণমাধ্যমকে জানান।নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীকে বিভিন্ন সময় আমার কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে আসেননি। অথচ আ’লীগের প্রার্থীর সভায় অংশ নিয়ে তিনি তার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি কিছুতেই এমনটি করতে পারেন না। তিনি দলের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করছেন। দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী তার এসব কর্মকা-ের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আমি দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কাছে পাঠিয়েছি। তারা ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন।
এ ব্যাপারে ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী বলেন, নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের সাথে আমার এলাকাবাসীর মতবিনিময় সভা ছিলো। এটি কোন রাজনৈতিক দলের সভা ছিলোনা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমরা ভোট চেয়েছি। আমাদের এলাকায় যারাই আসবেন আমরা তাদেরকে আমরা দোয়া দিবো।অপরদিকে, ১৪ মে রোববার নিজ দলীয় প্রার্থী রেখে আ’লীগের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ায় সাবেক এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীকে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়েছে জাতীয় পার্টি।পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক (২) এমএ রাজ্জাক খান স্বাক্ষরিত এ নোটিশে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কেন্দ্রীয় দফতরে লিখিতভাবে জানানোর জন্য ইয়াহইয়া চৌধুরীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।এরআগে গত ১২ মে শুক্রবার রাতে নগরির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ঝেরঝেরিপাড়ায় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহইয়া চৌধুরী। বক্তব্যে নৌকা মার্কায় ভোট চান জাপার এই কেন্দ্রীয় নেতা। এরপর স্যোশাল মিডিয়ায় বক্তব্যের ভিডিওটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াহইয়ার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রের কাছে নালিশ জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোববার ইয়াহইয়া চৌধুরীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলো জাতীয় পার্টি।সিটি নির্বাচন নিয়ে দলের সব নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ এবং জাতীয় পার্টির জয় সুনিশ্চিত দাবি করে, দলটির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, দলে কোনো কোন্দল নেই। সিলেটে দু’বার করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। বিপুল অর্থ বরাদ্দ পেলেও তারা কাঙ্খিত উন্নয়ন করতে পারেননি। মানুষ তাই পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা এবার লাঙল প্রতীকেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
উল্লেখ্য, সিলেটে মেয়র পদে এখন পর্যন্ত ৭জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্যে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদুল হাসান ও জাতীয় পার্টি মনোনীত নজরুল ইসলাম বাবুল।এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মো.আবদুল হানিফ (কুটু), মোহাম্মদ আবদুল মান্নান খান, সামছুন নুর তালুকদার ও মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
সিলেট সিটি নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৩মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন প্রার্থীরা। ২৫ মে মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের পর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১ জুন। ২ জুন প্রতীক বরাদ্দের পর ২১ জুন ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে।