স্মরণে ফজলুল হক মিয়া চাচা
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
আমি যখন ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়তে যাই, তখন আমার পরিবার একধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৮৫ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে আমার বাবা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সে সময়কার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, জেনারেল এরশাদের কলমের এক খোঁচায় এমএলও-৯ নামে এক অদ্ভুত সামরিক আইনে সরকারি চাকরি হারিয়েছিলেন। পরে মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে তিনি ১৯৯১ সালে আবার তার সরকারি চাকরি ফিরে পান, কিন্তু ভোগান্তির শেষ তখনও হয়নি।দেশে তখন ‘গণতান্ত্রিক’ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে আর জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতার মসনদে। একটি ‘বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদী সরকার‘ প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। সংগত কারণেই সে সময়কার প্রধানমন্ত্রীর ঘোর আপত্তি ছিল আমার বাবার সরকারি চাকরিতে পুনরায় যোগদানে। সে সময়কার সংস্থাপন (আজকের জনপ্রশাসন) সচিবকে এ ব্যাপারে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের বাধ্যবাধকতায় সরকার একসময় আমার বাবার চাকরিতে যোগদান গ্রহণে বাধ্য হলেও, পোস্টিং না দিয়ে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল আরও অনেকটা সময়। সরকারি চাকরিতে একে আমরা বলি ওএসডি।
এরপর তাকে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের খুলনা জোনের দায়িত্ব দিয়ে। এ সময় আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র এবং ময়মনসিংহে বসেও কিন্তু আমরা তখন জাতীয়তাবাদের যে উত্তাপ তা পুরোপুরি পাচ্ছি, টের পাচ্ছিল দেশের আর সবাই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের যারা ছাত্রলীগের কর্মী, তারা সে সময় হোস্টেল ছাড়া হয়ে ময়মনসিংহ শহরের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বসতি গেড়েছে। আমরা থাকতাম ব্রাহ্মপল্লীর একটা ফ্ল্যাটে। আমার অন্যতম রুমমেট ছিল ইমন, সাথে আরও দুজন। আমার বাবা যে সময়টায় খুলনায় যান, ইমনের বাবা ফজলুল হক মিয়া চাচা ছিলেন সে সময় খুলনার বিভাগীয় কমিশনার।আমাদের দুজনের দোস্তি যখন ময়মনসিংহে, তখন দুইজনের বাবার গলায় গলায় সখ্য খুলনায়। অবশ্য ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর থেকেই ইমনের সাথে আমার বন্ধুত্বটা পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল আর দুজনের বাবা যখন একসাথে কাকতালীয়ভাবে খুলনায় পোস্টেড, তখন এই সম্পর্কটা একটা পাকাপোক্ত সম্বন্ধে জড়িয়ে যায়।
দুই পরিবারের সেই যে সম্পর্ক, সেটা কিন্তু এখনও অটুট। এই আজকে যখন আমি সপরিবারে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ইমনের চিকিৎসায় ফোনে ফোনে ভালো হচ্ছি, তখন ইমনের ছোট বোন পুনমের সাথে যোগাযোগ আমার বোন মুনমুনের। ফোনে যখন আমার খবর নিচ্ছেন ইমনের মা, ইমনের খালা মিসেস সেলিনা মোমেনও (মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী) আমাদের খবর রাখছেন। যখন ফেসবুকে ইমনের খালাতো বোন পারভিন আপা (মিসেস আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি) আমাদের সুস্থতা কামনা করছেন, তখন ওর ছোট বোন বিনার হাসব্যান্ড মাহবুব ভাই (শিক্ষা সচিব) ফোনে কুশল জানতে চাচ্ছেন আমাদের। সম্পর্কটা এখনও এমনই। যা হোক, খুলনায় ওই যে একসাথে পোস্টিং আমার বাবা আর ইমনের বাবা ফজলুল হক মিয়া চাচার, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুজনের জন্য।
খুলনা জোনের দায়িত্ব ছাড়া আমার বাবার অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল সে সময় ফরিদপুর এডিপির অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রোড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (আরআইপি) প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের দায়িত্ব পালন। এটি ছিল একটি রুগ্ন প্রজেক্ট। কিন্তু সে বছর-ই প্রজেক্টের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। শুধু তাই নয়, লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পরও প্রায় একুশ কোটি টাকা, যতদূর মনে পরে, উদ্বৃত্ত ছিল। কাজ শেষে এই উদ্বৃত্ত টাকাটি সরকারি কোষাগারে ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে এ সময় আমাদের দুজনের বাবা একটি দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন। ঢোলে বাড়িটা দিয়েছিলেন ফজলুল হক চাচাই আর আগুনে ঘি’টা ঢেলেছিলেন শেখ হেলাল মামা (আজকের মাননীয় সংসদ সদস্য শেখ হেলাল)। অতএব আর যায় কোথায়, উদ্বৃত্ত সেই অর্থের কিছুটা অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত না পাঠিয়ে তাই দিয়ে তৈরি হলো টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত ইট সোলিং করা হেরিংবোন রাস্তাটি।
খুলনার এই দুই অবাধ্য সরকারি কর্মকর্তার এ ধরনের অবাধ্যতা একেবারেই ভালোভাবে নেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ভারী গোস্বা হয়েছিল তার। আমার মরহুম দুই মামা মাসুদ আহমেদ ও মনসুর আহমেদ ছিলেন সিএসপি কর্মকর্তা। তাদের সমসাময়িক একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার মুখে শুনেছি এটা। অবাধ্য কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। এসএসবি শেষে সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য ফজলুল হক চাচার ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ছিল। সে ফাইলে স্বাক্ষর না করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করলেন তার বাধ্যতামূলক অবসরের ফাইলে। এটি ১৯৯২ সালের কথা। ফজলুল হক চাচা সহসাই সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রথম শিকারে পরিণত হলেন।
আমার বাবার কানের পাশ দিয়ে সে সময় বুলেটটি গিয়েছিল, সদ্য মামলা করে ফিরে আসা কর্মকর্তাকে আবারও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় নিরুৎসাহিত করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মরত কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা। অতএব মামলাবাজ হিসেবে পার পেয়ে যান আমার বাবা। তাকে বরখাস্ত না করে আবারও করা হয় ওএসডি।বাবার এই সহসা দুঃসংবাদটি ইমনের কেমন লেগেছিল আর কেউ না বুঝলেও বুঝেছিলাম আমি। কারণ জেনারেল এরশাদ যেদিন আমার বাবার বরখাস্তটির ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেদিন তার ফাইলটি আসলে পরম প্রতাপশালী সামরিক শাসকের টেবিলে উত্থাপন করা হয়েছিল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তার প্রমোশনের জন্য। তা না করে উল্টো বরখাস্তের আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন সিএমএলএ এরশাদ। ‘আকাশ থেকে ধপাস’ করে পড়ার যদি কোনো বিষয় থেকে থাকে তাহলে ব্যাপারটা সে রকম-ই ছিল।
সরকারি সিদ্ধান্তটি ফজলুল হক চাচার জন্য কঠিন ছিল বলেই মনে হয়। সে সময় তিনি উত্তরায় মাত্রই তার বাড়িটি নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। তার সাধের বাড়িটির নাম মধুমতি। ইমনের ছোট বোন বীণা তখন কলেজছাত্রী, পুনম আরও ছোট। বড় বোন মোনা আপা সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অনেকদিন আগের কথা, স্মৃতিতে বিস্মৃত হয়ে আসছে অনেক কিছুই। তবে একটা জিনিস খুব ভালো মতো মনে আছে, টলেননি শত আঘাতেও ফজলুল হক চাচা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে একচুলও। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বড় আপা এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দেন ফজলুল হক চাচা। ১৯৯৬ এ যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, সে নির্বাচনী কর্মযজ্ঞে তিনি জড়িত ছিলেন আগাগোড়াই। যতদূর মনে পড়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনুফেস্টো তৈরিতেও নেত্রী তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের আজকের এই দিনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ফজলুল হক চাচারও দাওয়াত ছিল বঙ্গভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে তার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেদিন দুপুরেই হার্ট অ্যাট্যাকে মৃত্যু হয় তার। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় আপার প্রথম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছিল উত্তরার মধুমতিতে ফজলুল হক মিয়া চাচার মৃতদেহ দেখতে যাওয়া।একজন ফজলুল হক মিয়াকে নিয়ে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, এমন অনেক ফজলুল হক মিয়াদের অনেক বড় বড় আত্মত্যাগেই আজ একাত্তরে এত তরুণ আওয়ামী লীগ আর এত শক্তিশালী বড় আপার হাত। আর বড় আপা শক্তিশালী বলেই এত বেশি নিরাপদ আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। ইতিহাসকে ভবিষ্যতের সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়ার যে তাগিদ, সেই তাগিদ থেকেই এই লেখাটি। কোনো ব্যক্তিকে মহীয়ান করা এই লেখার উদ্দেশ্য একদমই না।
লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।