হবিগঞ্জে মানচিত্র থেকে মুছে গেছে ২৮ নদীর নাম
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ কালের বিবর্তনে, দখলে-দূষণে হবিগঞ্জে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বহু নদীর নাম।যেগুলো এখনও টিকে আছে, সেগুলোও পরিণত হয়েছে খাল বা নালায়। সত্তরের দশকে ৫০টির বেশি নদী থাকলেও এখন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় আছে মাত্র ২২টি নদীর নাম।হবিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, একসময় হবিগঞ্জ জেলার প্রাণ ছিলো ছোট-বড় নদীগুলো। সেই নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই মূলতঃ গড়ে ওঠে জনপদ। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। এসব নদী ও খাল দখল করে গড়ে উঠেছে বসতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনা। সেই সঙ্গে নদীশাসনে মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে কুশিয়ারা, কালনী, খোয়াই, ধলেশ্বরী, সুতাং, রত্মা এবং করাঙ্গীর মতো বড় নদীও।
নবীগঞ্জের একসময়ের খরস্রোতা শাখাবরাক নদী। এই নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছিল নবীগঞ্জ শহর। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদীপথ। এই নদী দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করত শত শত নৌযান।
নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এই এলাকার বহু মানুষ। গেল ৪ দশকে সেই নদীটি এখন মৃতপ্রায়। নদীর দুইপাশ দখল করে গড়ে উঠেছে শত শত বসতি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে ওই নদী।নদীটি নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে শহরের অনমনু গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী ধনাই মিয়া বলেন, ‘নদীটির দিকে চাইলে কষ্ট লাগে। একসময় এই নদীর কী যৌবন ছিল। নদীর দুই পাশে শত শত নৌকা বাঁধা থাকত। এসব নৌকা বিভিন্ন এলাকা থেকে কত মালামাল নিয়ে আসত নবীগঞ্জে। আর মাছের কথা কী বলি, ডুব দিয়ে খালি হাতে মাছ ধরে নিয়া আসা যাইত। এখন এই নদী লাফ দিয়ে পার হওয়া যায়।দখলের কবলে বিলীনের পথে বাহুবলের করাঙ্গী ও মাধবপুরের সোনাই। শিল্পবর্জ্য দূষণে মৃতপ্রায় সুতাং আর ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে শুঁটকি নদী। চরম সংকটে রয়েছে রত্মা এবং হবিগঞ্জ শহরকে ঘিরে থাকা খোয়াইও।লাখাই উপজেলার লুকড়া এলাকার বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেক নদী ছিল। সেগুলোর অনেক নদীই এখন নেই। কয়েকটা নদী খালের মতো হয়ে গেছে। একসময় সেগুলোতে অনেক মাছ পাওয়া গেলেও এখন হাত-পাও ধোয়া যায় না।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এসব নদী হারিয়ে যাওয়া এবং দখল-দূষণের জন্য সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দায়ী। এখনও যেসব নদী টিকে আছে, এগুলো সংরক্ষণ করা না হলে কয়েক বছর পর সেগুলোও হারিয়ে যাবে। এতে চরম সংকটে পড়বে পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণীকূল।জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সময়ে হবিগঞ্জে কতটি নদী ছিল সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে ২০২১ সালের করা একটি তালিকায় তাদের কাছে ২২টি নদী ও ৬৩টি খালের নাম রয়েছে। খালগুলোর চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত নদীগুলো বাঁচানোর উদ্যোগ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।এরমধ্যে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রত্মা ও ধলেশ্বরীর ৮ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজ চলমান রয়েছে। সেই সঙ্গে ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে খনন চলছে বিজনা, গোপলা, করাঙ্গী, কাস্তি, সোনাই নদীর ১১৭ কিলোমিটার। যার ৫০ শতাংশ কাজ শেষ।হবিগঞ্জ শহরের পুরাতন খোয়াই নদী রক্ষায় ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে নদীর পশ্চিমপাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। আর শহর থেকে অন্তত ১২ ফুটের বেশি ওপরে উঠে যাওয়া নতুন খোয়াই নদী ড্রেজিংসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ১৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
যে ৫টি নদীর খনন কাজ চলছে, সেগুলো নিয়ে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। স্থানীয়রা বলছেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে খননের নামে নদীকে খালে রূপান্তরিত করার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে নবীগঞ্জের বিজনা নদী খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেছেন স্থানীয় জনগণ। বাহুবলের করাঙ্গী নদী খননে অনিয়মের অভিযোগ এনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেও ব্যর্থ হয়ে এখন নীরব স্থানীয়রা।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘নদী হারিয়ে যাওয়া এবং দখল দূষণের জন্য সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দায়ী। তারা এসব নদী রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই প্রতিনিয়ত নদী দখল হচ্ছে। এছাড়া, যে সরকারই যখন ক্ষমতায় আসে, সেই সরকারের ক্ষমতাশীল নেতারা নদী দখল করেন।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ‘নদীরক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে নদীর ওপর গড়ে ওঠা ৯৪২টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিগুলো উচ্ছেদের তালিকা তৈরি করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে হাইকোর্টে মামলা থাকায় ৩৩টি স্থাপনায় হাত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, ‘নদীদখল ও দূষণমুক্ত রাখতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর। এমনকি দখলদারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে আদালতেও লড়াই করছি আমরা।