৭ নভেম্বরের না জানা উত্তর
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
দেশের আর্থ-সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ইত্যকার নানা বিষয়ে আমি লেখালেখির চেষ্টা করি। সাথে স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখিতো আছেই। তবে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিয়ে লেখার চেষ্টা কখনোই করিনি। কেউ অনুরোধ করলেও সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণটা খুব সাধারণ। সিপাহী জনতার তথাকথিত এই বিপ্লব বার্ষিকীটি সম্বন্ধে আমার জানার চেয়ে অজানা বেশি। এ নিয়ে মনে একগাদা প্রশ্ন, যার কোনোটিরই উত্তর শত চেষ্টায়ও আমার মাথায় ঢোকে না। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি আর উত্তর হাতড়াতে-হাতড়াতেই কোনদিক দিয়ে যেন নভেম্বরটা পার হয়ে যায়। তারপর একসময় বাদবাকিদের মতো আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজয়টি আরও একবার উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে। এবার যখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে আবারও নভেম্বর, তখন উত্তর খুঁজতে থাকা এই প্রশ্নগুলোর আর দশজনের সাথে ভাগাভাগি করার তাগিদ থেকেই এই প্রথমবার ৭ নভেম্বর নিয়ে আমার এই লিখতে বসা।
বাঙালি জাতির জন্য তার স্বাধীন অস্তিত্বে সবচেয়ে শোকাবহ দিনটি আগস্টের ১৫ আর তারপর যে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কুচকুচে কালো কালি লেপে দিয়েছে তা ৩ নভেম্বর। বাংলাদেশকে চূড়ান্তভাবে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণিত অধ্যায়টি এদিন রচিত হয়েছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগার হওয়ার কথা পৃথিবীর নিরাপদতম স্থান। সেই কারাগারে প্রবেশ করে এমনি হত্যাকান্ড ঘটানোর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। শোনা যায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তির ফোনে আদিষ্ট হয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন খুনিদের জন্য কারাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এতো বড় একটি ঘটনা কেন কান কথা হয়ে রয়ে যাবে? কার নির্দেশে সেদিন পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠার পরও কারাগারে ঘুকতে পেরেছিল জাতীয় চার নেতার খুনিরা সেই প্রশ্নের উত্তর কই? আর ওই যে লোকগুলো, ঘটনার নেপথ্যে বসে যারা নাড়াচাড়া করছিল কলকাঠিগুলো, তারাই বা কারা? তাদের নামগুলো কি আমাদের কখনো জানা হবে না?
বাংলাদেশের সে সময়কার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি ছিলো আজকের বহুধা বিভক্ত জাসদ। এর একটা কারণ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো ছিল রাজনীতির ভাগাড়ে। পঁচাত্তরের আগস্টে আর তারপর নভেম্বরের ৩ তারিখের ঘটনা প্রবাহে রাজনৈতিক দল হিসাবে সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছিল আওয়ামী লীগের উপর আর সঙ্গত কারণেই এর সবচাইতে বড় বেনিফিসিয়ারি হওয়ার কথা ছিল জাসদের। সেই জাসদ কি মনে করে ৭ নভেম্বর ক্ষমতার বলটা জেনারেল জিয়ার কোর্টে ঠেলে দিয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও খুজে পাইনি। ৭ নভেম্বর-উত্তর বাংলাদেশে জাসদ রাজনৈতিকভাবে আর কোনোদিনই তার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। বরং তামাশার বিচারে, আইনের রেট্ট্রোস্পেক্টিভ প্রয়োগের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া তার একাত্তরের সহকর্মী কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে তো বটেই, সেই সাথে জাসদকেও এত্তবড় বৃদ্ধাঙ্গুলিটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার আরেকটি বড় প্রশ্ন কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে। সেসময় তারা ছিল বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি। আজকের মতো সেদিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে খুঁজতে অতসী কাচের প্রয়োজন পরতো না। অথচ তাদেরও এসময়টায়, আগে-পরে আমরা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখিনি। বরং যে কথাটা জানতাম না, জানলাম শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাম্প্রতিক একটি লেখায়, তারা সেদিন উল্টো জেনারেল জিয়ার খাল কাটা কর্মসূচিতে কমরেডদের জোগান দিয়ে সন্তুষ্টির ঢেকুড় তুলছিলো। প্রতিদানে তাদের ঘাড়ে জেনারেল জিয়ার খড়গের আঘাতটা জাসদের মতো অতোটা শক্ত ছিলো না। মনে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খায় সেটি হলো, ‘তাহলে কেন খাল কাটা?’
আর যাকে বলে লাখ টাকার প্রশ্ন, যার উত্তরটাও আমি যথারীতি জানি না, তাহলো জেনারেল খালেদ মোশাররফ আর তার সাথের সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকাটা। তারাই বা কেন জেলে বন্দী জাতীয় নেতাদের কারামুক্ত করার উদ্যোগ নেননি? প্রশ্ন অবশ্য আরো একটা আছে। বঙ্গবন্ধু আর জাতীয় চার নেতার রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতার হালুয়ায় ভাগ বসিয়েছিলেন যে এমপি-মন্ত্রীরা তাদের আর কেউ না হলেও ভালই চিনেছিলেন জেনারেল জিয়া। কাজেই ৭ নভেম্বর-উত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদে বসেই এদের ভাগাড়ে ছুঁড়ে ফেলতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। তিনি বরং আস্থা রেখেছিলেন, আস্থা যেখানে রাখা উচিত সেই জায়গাটিতেই, একাত্তরের পরাজিত শক্তির উপর। প্রশ্ন জাগে, সেদিন যারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আজকের এই ৭ নভেম্বরেও নিউ-নরমাল বাংলাদেশে দিব্যি মাস্কে মুখ ঢেকে ঘুরছেন-ফিরছেন, তাদের কি এতোদিন মাস্কে মুখ না ঢেকে ঘুরাঘুরি করতে এতোটুকুও লজ্জা লাগেনি। কী জানি, উত্তর তো জানি না।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।