৭০৪ বছর ধরে সিলেটে পালিত হচ্ছে লাকড়ি তোড়া উৎসব

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ লাকড়ি তোড়া উৎসব। সিলেটের আদি সংস্কৃতি। সিলেটের অন্যতম এ উৎসব। ৭০৪ বছর ধরে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। বর্ণিল এ আয়োজনে সিলেট মেতে উঠে ভিন্ন সাজে। বিশেষ করে চায়ের বাগান লাক্কাতোড়া থেকে দল বেঁধে লাকড়ি নিয়ে আসা হয়। আর ওই লাকড়ি স্তূপ করে রাখা হয় প্রাচ্যসূর্য্য, সুলতানুল আউলিয়া, ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল মজররদে ইয়ামেনি (রহঃ)-এর মাজারে। ওরশে শিরনি রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় এই লাকড়ি।ইতিহাস থেকে জানা যায়, শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংসের শিক্ষা নিয়ে ৭শ’ বছরের বেশী সময় থেকে সিলেটে এ উৎসব উদযাপন করা হয়। সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) এর স্মৃতিবিজড়িত এ উৎসব হিজরি বর্ষের ২৬শে শাওয়াল পালন করা হয়।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট বিজয় দিবসের কয়েকদিন আগে শাহজালাল (রহঃ)-এর ভক্ত এক কাঠুরে আসেন হযরত শাহজালালের (রহঃ) কাছে। কাঠুরে জানান, ঘরে তার বিবাহযোগ্য ৫ মেয়ে রয়েছে। সে কাঠ কাটে এবং নিচুজাতের হওয়ায় কেউই তার মেয়েদের বিয়ে করতে চাইছে না। এ কথা শুনে শাহজালাল (রহ.) খুবই মর্মাহত হলেন এবং কাঠুরেকে সিলেট বিজয় দিবসে দরগায় আসার কথা বলেন।

পরবর্তীতে সিলেট বিজয় দিবসে সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়া, ভক্ত ও আশেকানরা এলে শাহজালাল (রহ.) সবাইকে নিয়ে লাক্কাতোড়া বাগানে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করেন। ফিরে এসে তিনি উপস্থিত ভক্তদের কাছে জানতে চান, ‘আজ সবাই কী কাজ করেছেন?’ উত্তরে সবাই বলেন, ‘আমরা আজ কাঠুরিয়ার কাজ করেছি।’ এরপর শাহজালাল (রঃ) সবাইকে কাঠুরের দুঃখের কথা বললে উপস্থিত অনেক ভক্ত কাঠুরের মেয়েদের বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেখান থেকে কাঠুরে তার মেয়েদের জন্য বর পছন্দ করেন। এ ঘটনার পর থেকে সাম্য ও শ্রেণী বৈষম্যবিরোধী দিবস হিসেবেও দিনটি পালন করেন ভক্তরা।মাজার সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, মূলতঃ ৪টি কারণে সিলেটে শত শত বছর থেকে এই উৎসব পালন করা হচ্ছে। হযরত শাহজালাল (রহঃ) মাজারের বর্তমান মোতাওয়াল্লী সরেকওম ফতেহ উল্লাহ আল আমান, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। অনাদিকাল এ উৎসব চলবে, ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, এই উৎসব কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের একার উৎসব নয়। এই উৎসবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লাখ লাখ জালালী ভক্ত মানুষ অংশ নিয়ে থাকে। তাই এটাকে আমরা সার্বজনীন উৎসব বলে থাকি। ইনশাল্লাহ আগামী ২১/২২ দিন পর ২ বছর বিরতি দিয়ে আমরা মুক্ত পরিবেশে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে ৭০৩ তম বার্ষিক ওরশ মাহফিল পালিত হবে।

বাংলাদেশ মাজার ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, সিলেট জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি, সদর দক্ষিণ নাগরিক কমিটি, সিলেট’র সভাপতি, সিলেট বিভাগের অন্যতম বিশিষ্ট সালিশ ব্যক্তিত্ব, সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ শেখ মোঃ মকন মিয়া জানিয়েছেন, ‘লাকড়ি তোড়া উৎসবের দিনকে সিলেট বিজয় দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। ওইদিন হযরত শাহজালাল (রহৎ) ৩৬০ আউলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটে এসে তখনকার প্রজা নির্যাতনকারী এবং অত্যাচারী রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট জয় করেন। এ কারণে ওইদিনকে সিলেট বিজয় দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এদিন হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর মুর্শিদ ক্বেবলা শায়খ সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ)’র ওফাত হয়। এ কারণে এদিনে বিশেষ প্রার্থনাও করা হয়। এছাড়া হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর প্রতি প্রচন্ডভাবে অনুরক্ত দু’জন কাঠুরিয়ার মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো এদিন। লাক্কাতোড়া বাগান থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসার পর দরগাহে বসে বর নির্ধারণ ও বিয়ে দেয়া হয়। কাঠ কাটার মাধ্যমে কাঠুরিয়ার জীবনের কষ্টের বিষয়ও তুলে ধরা হয় এই উৎসবে। এ কারণে প্রতিবছর এ দিনকে লাকড়ি তোড়া ওরশ কিংবা লাকড়ি তোড়া উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।এদিকে, লাকড়ি তোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে শনিবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত ও আশেকানের ঢল নামে সিলেট নগরে। সকাল থেকে ট্রাকযোগে সুফীগান বাজিয়ে ভক্তরা মিছিলসহ আসেন মাজার প্রাঙ্গণে। দুপুর গড়াতেই মাজার এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। নেচে গেয়ে সিলেট বিজয়ের এই দিনকে পালন করেন ভক্তরা। তবে মাজার কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে সব আরো কর্মসূচি পালন করেছেন। বাদ জোহর মাজারের প্রধান ফটকের সামনে মোনাজাতের মাধ্যমে উৎসবের শুরু করা হয়। এরপর সবাই দল বেঁধে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা লাক্কাতোড়ার চা বাগান এলাকায় যান। সেখানে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হয়। এরপর উপস্থিত সকলের মাঝে শিরনি বিতরণ করা হয়। সবাই লাক্কাতোড়া বাগান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে ফের মিছিল সহকারে মাজার প্রাঙ্গণে আসেন।

মাজারের অন্যতম খাদেম এবং মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সামুন মাহমুদ খান জানিয়েছেন, হযরত শাহজালাল (রহঃ) ওরশের ২২/২৩ দিন আগে এই লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করা হয়। ভক্ত ও আশেকানরা যে লাকড়ি নিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে আসেন সেগুলো সংরক্ষিত করে রাখা হয়। এরপর এই লাকড়ি ওরশের শিরণি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া লাকড়ি তোড়া ওরশকে কেন্দ্র করে খতমে কোরআন, মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিলেরও আয়োজন করা হয়েছে।এদিকে, লাকড়ি তোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত ও আশেকানরা আসেন ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রহঃ) মাজারে। সকাল থেকে তারা মাজারের আঙিনা, পুকুরপাড়, ঝরনারপাড় এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় সবার মাথায় থাকে লাল কাপড় বাঁধা। কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সুফীগানও করেন। ভক্তি ও আশেকানি গানে সকাল থেকে মুখরিত হয়ে উঠে মাজার এলাকা। লাকড়ি নিয়ে আসার পরও গান চলে।হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মুড়ারবন্দ থেকে এসেছিলেন ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) মাজারের অন্যতম খাদেম গিয়াসউদ্দিন পীর নজরুল আহমদ চিশতি। তিনি জানান, ৭০৪ বছর ধরে সিলেটে লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ বছর থেকে তিনি দলবল নিয়ে এই উৎসবে শরীক হন। গত দু’বছর করোনা মহামারির কারণে স্বল্প পরিসরে উৎসব পালন হয়। এবার মুক্ত পরিবেশে ওরশ হওয়ায় ভক্তদের ঢল নেমেছে।

তিনি বলেন, এই উৎসবের মহাত্ম অনেক। হযরত শাহজালাল (রহঃ) স্মৃতিবিজড়িত এই উৎসবে সবাই অংশ গ্রহণ করে থাকেন। দেশের দূর-দূরান্ত থেকেও ভক্তরা এসেছেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) ৩৬০ আউলিয়া ভক্তবৃন্দ পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, সিলেট বিজয়ের এই দিনে আলোকিত হয়েছিল এ জনপদ। সূদূর ইয়েমেন থেকে ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে সিলেট এসে আসন গেড়েছিলেন শাহজালাল (রহঃ)। ফলে এই দিনটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এই দিন থেকে আমরা মূল ওরশের প্রস্তুতি শুরু করি।
এদিকে, এবার উৎসবে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি থাকার কারণে বিকেল পর্যন্ত লাকড়ি সংগ্রহ করা হয়। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে আবার কেউ কেউ দল বেঁধে গিয়ে লাকড়ি সংগ্রহ করেন। উৎসব উপলক্ষে ভক্ত-আশেকানের ঢল নামার কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে হযরত শাহজালাল (রহঃ) মাজার এলাকা থেকে লাক্কাতোড়া বাগান পর্যন্ত বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

You might also like