ইউনুস-তারেক, নাকি ইউনুস-স্টারমার অগ্রাধিকার ছিলো কোন বৈঠকের?
কূটনৈতিক ব্যর্থতা? লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনার বললেনঃ না
মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার
এডিটর অ্যাট লার্জ, সত্যবাণী
লন্ডন: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রবল শক্তিধর পাঁচটি সদস্য-রাষ্ট্রের অন্যতম ব্রিটেনের কোন প্রধানমন্ত্রী, জানা মতে, এই প্রথম বাংলাদেশের কোন সরকার প্রধানের দেয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সম্প্রতি তাঁর লন্ডন সফরকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্টারমার তা প্রত্যাখ্যান করেন বলে ব্রিটেনের মূলধারার মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ রকম একটি ঘটনা দু’দেশের সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব রেখে থাকে। এই নজিরবিহীন ঘটনার প্রেক্ষিতে
দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি মেরামতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ড্যামেজ কন্ট্রোলের কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের নতুন হাইকমিশনার আবিদা ইসলামকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার ১৯ জুন সন্ধ্যায় কমিউনিটি কোশ্চেন টাইম অনুষ্ঠানে।
কিন্তু বিষয়টি ঢাকা লন্ডনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত (ড্যামেজ) করেছে – বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সে কথার সাথে একমত নন।
তিনি বললেন, ‘একটা বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শিডিউল কনফ্লিক্টের কারণে সেটা হয়নি। এটা সরকারী সফর হিসেবে তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বিবিসির সাথে ইন্টারভিউতে বলেছেন, এটা একটা মিসড অপারচুনিটি। একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিবও বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সফর ‘খুবই সফল’ হয়েছে। তাই এখানে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার মতো কিছু বা নেতিবাচক কোন প্রতিক্রিয়া- সেভাবে আমি দেখছি না। আমরাও দেখছি না, আমাদের সরকারও দেখছে না’।
বিষয়টির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটি কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের সাথে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস সম্পৃক্ত ছিলো না। সব কিছু করেছে ঢাকায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও সেভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
লক্ষ্যণীয় যে, সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী (উপদেষ্টা) তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে থাকেন, এটা রীতি। কিন্তু ড. ইউনুসের সফরের সময় তৌহিদ হোসেনকে সাথে আনা হয়নি। এই সফরকালে ড. ইউনুসের মুখ্য সহায়ক ছিলেন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব (পূর্বতন) রুহুল আলম সিদ্দিকী দাবী করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন এসে পৌঁছা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের বিষয়টি এজেন্ডায় ছিলো। কিন্তু বৈঠকের দিনক্ষণ সেখানে নির্ধারিত ছিলো না। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিলো, শেষ মুহূর্তে হলেও বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ‘যে কোনো কারণেই হোক’ সেটি আর শেষ পর্যন্ত হয়নি।
পর্যবেক্ষকদের বিশেষ দৃষ্টি এদিকটায়।
আমাদের সরকার প্রধান লন্ডন এসে পৌঁছানোর পর বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করা যাবে, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা যদি এমনটা ভেবে থাকেন, সেটা তাঁরা ভাবলেন কী করে? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন কার্যতালিকা কতোদিন আগে থেকে ঠিক করা থাকে, সে সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চয়ই পূর্ণ ওয়াকিবহাল।
সমস্যাটা আসলে কোথায় ছিলো?
এ নিয়ে তিনটি সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখা যায়।
এক. সরকারী কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, ড. ইউনুসের যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং অবস্থান, আগে থেকে ঠিক করা না থাকলেও, ড. ইউনূস লন্ডন এসে পৌঁছুবার পর তাঁর সাথে বৈঠকে বসার বিষয়টি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারবেন না, বৈঠকে তাঁকে বসতেই হবে। সুতরাং, বড় একটি উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবেই।
দুই. তাঁরা ভেবেছিলেন, রীতি মোতাবেক একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করা না গেলেও দু’জনের মধ্যে কিছু সময়ের একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা অবশ্যই করা যাবে। এই ধারণা সঠিক হলে তাঁরা ড. ইউনুসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির ওপর অতিমাত্রায় আস্থা রেখেছিলেন – বলতে হয়, পরিণামে যা ব্যাকফায়ার করেছে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ঘোষণা দিয়ে তা আয়োজনে ব্যর্থতা ড. ইউনূসের সম্মান ও অবস্থানকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি দেশ হিসেবে ক্ষুন্ন করেছে বাংলাদেশের মর্যাদাও।
তিন. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকটি তাঁদের কাছে সেকেন্ডারি ছিলো। মূল আরাধ্য ছিলো, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বৈঠক। তাঁরা কী এ রকমই ভেবেছিলেন যে, তারেকের সাথে বৈঠকটিই মূল কাংখিত, স্টারমারের সাথে বৈঠকের আয়োজন যদি করা সম্ভবই হয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে বোনাস?
লন্ডনে বাংলাদেশের একজন শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের দিনক্ষণ আগে নির্ধারণ করা ছিলো না। আমাদের বলা হয়েছিলো, প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন পৌঁছার পরের দিন ১১ জুন বৈঠকটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পরে জানলাম, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাজেট কেন্দ্রিক স্পেন্ডিং রিভিউ নিয়ে পার্লামেন্টারী আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, বৈঠক হচ্ছে না। তিনি বলার চেষ্টা করেন যে, প্রধান উপদেষ্টা ব্রিটেন সফরে এসেছিলেন ব্রিটেনের রাষ্ট্র প্রধান তথা রাজার আমন্ত্রণে (রাজার কাছ থেকে এওয়ার্ড নেয়ার জন্যে), রাজার সাথে একান্ত বৈঠকও তাঁর হয়েছে। তাই সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সাথে বৈঠক না হলেও তা কূটনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখাটা ঠিক নয়।
যখন ব্রিটিশ মূল ধারার মিডিয়ায় বলা হয়, ড. ইউনূসের সাথে বসতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, যখন খোদ ড. ইউনুসকে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে এই বিব্রতকর প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য হতে হয়, তারপরও বিষয়টি কূটনৈতিক কোন সমস্যা নয়, এ রকম ধারণা দেয়ার চেষ্টা প্রচলিত কূটনৈতিক রীতিনীতির কতোখানি যথার্থ প্রতিফলন?
এখানে কূটনৈতিক ব্যর্থতা কী আড়াল করার চেষ্টা চলছে রাজনৈতিক ডামাডোলের আড়ালে?
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট করে বলা উচিত, ড. ইউনুসের লন্ডন সফর কী ব্যক্তিগত সফর ছিলো, না-কি তা ছিলো সরকারী সফর। তাঁর সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনে ব্যর্থতাকে তিনি ‘মেজর মিসটেক’ বলে বর্ণনা করেছেন।