উইল ফ্রেডআ ওয়েনের প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ
দিলীপ মজুমদার
১৯২০ সালের পয়লা আগস্ট।রবীন্দ্রনাথ তখন লণ্ডনে।এখান থেকে প্যারিস যাবার কথা । তাঁর নাম লেখা অথচ ঠিকানাবিহীন এক অদ্ভুত চিঠি এল তাঁর হাতে।লিখছেন সুসান আওয়েন নামে এক নারী :
প্রিয় স্যার রবীন্দ্রনাথ,
আপনি লণ্ডনে এসেছেন শুনে আপনাকে চিঠি লিখব বলে মনস্থির করেছিলাম ,কিন্তু যথেষ্ট সাহস জোগাড় করে উঠতে পারি নি।আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে যা এই চিঠিতে আমি নিবেদন করতে চাই।এ চিঠি হয়তো আপনার হাতে পৌঁছাবে না,কারণ আপনার ঠিকানা আমার জানা নেই।তবে আমার স্থির বিশ্বাস খামের উপর আপনার নামটা ভারতীয় ডাক বিভাগের পক্ষে যথেষ্ট ।প্রায় দু’বছর আগে আমার বড়ছেলে উইলি ব্রিটেন থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।তাকে বিদা্য় জানানোর জন্য আমি যখন টিলবেরি ডকে যাই,তখন উইলি,যে নিজেও ছিল একজন কবি, আমাকে শোনায় আপনার লেখা কবিতার লাইন :
যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই,
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই ।
যুদ্ধের শেষে সে আমার কাছে আর ফিরে আসে নি,কারণ রণাঙ্গনেই তার মৃত্যু হয়েছে । তার অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে রক্তেভেজা তার পকেট বই ফেরৎ এসেছিল আমার কাছে । তার মধ্যে উইলির নিজের হাতের লেখায় আপনার কবিতার ওই দুটি লাইন ছিল । আপনার কোন বইতে পুরো কবিতাটি পাব , অনুগ্রহ করে জানাবেন ।
ভবদীয়া
সুসান আওয়েন
চিঠিটা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বড় বিষণ্ণ হন । পুত্রহারা এক মায়ের বেদনা স্পর্শ করেছিল তাঁর হৃদয় । তিনি নিজেও যে সন্তানহারা পিতা । অকালে চলে গেছে তাঁরও পুত্র-কন্যা । চলে গেছে রেণুকা , চলে গেছে শমী , চলে গেছে বেলা । বড্ড অকালে চলে গেছে তারা ।
কিন্তু বেদনার মধ্যেও একটা কথা ভেবে ভালো লাগছে তাঁর । তাঁর কবিতা একজনকে প্রেরণা দিয়েছে , ভরসা দিয়েছে , দিয়েছে সান্ত্বনা। তাঁর মনে পড়ে গেল ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কথা । প্রথমা মহিষী ভানুমতীর মৃত্যুতে শোকাকুল হয়ে উঠেছিলেন বীরচন্দ্র । তখন রবীন্দ্রের ‘ভগ্নহৃদয়ে’র কবিতাগুচ্ছ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিল :
স্নেহের অরুণালোকে খুলিয়া হৃদয়প্রাণ
এ পারে দাঁড়ায়ে, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান
তোমারই মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়—
একটি নয়নজল তাহারে করিও দান ।
আজিকে বিদায় তবে , আবার কি দেখা হবে—
পাইয়া স্নেহের আলো হৃদয় গাহিবে গান ?
উইলি বা তাঁর মা-ও তাঁর কবিতা পড়ে তেমনি সান্ত্বনা লাভ করেছেন । কিন্তু কে এই উইলি ?
উইলি হলেন উইলফ্রেড আওয়েন । ১৮৯৩ সালের ১৮ মার্চ ওসোওয়েস্ট্রিতে মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম।মা সুসান,বাবা টমাস।আগে জাহাজে কাজ করতেন বাবা । ভারতে গিয়েছিলেন । দেশে ফিরে সুসানকে বিয়ে করেন।এরপর তিনি স্টেশন মাস্টারের কাজে বহাল হন। আরও তিনটি ভাই-বোন ছিল উইলির।উইলি বড় ছেলে।উইলির যখন চার বছর বয়েস তখন তাঁরা মামাবাড়ি থেকে চলে আসেন।বসবাস শুরু করেন বার্কেনহেডে ।এখানকার এক স্কুলে বছর সাতেক পড়াশুনো করেছিলেন তিনি । তারপর বার্কেনহেড থেকে তাঁদের পরিবার চলে আসে শ্রিউসবারিতে।এখানকার টেকনিক্যাল স্কুল থেকে আঠারি বছরে স্নাতক হন উইলি।লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি জোগাড় করার চেষ্টা করেন।কিন্তু সফল হন নি।ডান্সডেনে এক যাজকের অধীনে কাজ করেছিলেন,কিন্তু ভালো লাগে নি ।কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ শৈশব থেকে । শেলি , কিটস প্রিয় কবি।কবিতা লেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয় ডান্সডেনে থাকার সময়ে । চিরাচরিত বিষয় নিয়ে লিখতেন কবিতা । তবে ছন্দের জ্ঞান ছিল ।ডান্সডেনে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকার ফলে অসুস্থ হন।বাড়ি ফিরে আসেন ১৯১৩ সালে।মনে মনে ঠিক করেছিলেন এবার থেকে তিনি শুধু কাব্য ও সংগীতের চর্চা করবেন ।কিন্তু বাধা হল দারিদ্র্য।বাবা বললেন চাকরির চেষ্টা করতে।সংসার বাঁচাতে হলে একটা স্থায়ী উপার্জন দরকার।বছরখানেক তিনি বারলিৎস স্কুল অব ল্যাঙ্গোয়েজে চাকরি করলেন।তারপর ফ্রান্সে এক ক্যাথলিক পরিবারে করলেন গৃহশিক্ষকতা । এসব কাজক্রম একদম ভালো লাগছিল না ।
১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরে এলেন বাড়ি।ততদিনে দামামা বেজে উঠেছে প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধের।সৈন্যদলে নাম লেখালেন উইলি।সাত মাস ট্রেনিং নিয়ে ম্যাঞ্চেস্টার রেজিমেন্টে সেকেণ্ড লেফটেনান্ট হিসেবে নিযুক্ত হলেন ।১৯১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর চলে গেলেন ফ্রান্স । প্রথম প্রথম ছিল একটা বীরত্বের গর্ব।মাকে লেখা চিঠিতে সে গর্ব প্রকাশ পেত । তিনি ভাবতেন তিনি এক দেশপ্রেমিকের কর্তব্য পালন করছেন।মনে হত যুদ্ধ যেন গৌরবময় ব্যাপার । সেসব দেখে মনে হত উইলি বোধহয় কবি রুপার্ট ব্রুকের পথের পথিক হবেন ।
কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর উপলবদ্ধিতে ধরা পড়তে লাগল যুদ্ধের আসল সত্য।মাকে চিঠিতে লিখলেন , ‘গত বারো দিন ধরে আমরা একটা স্যাঁতস্যাঁতে অপরিসর পরিখার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি । বৃষ্টির জল ঢোকার ফলে যার অবস্থা ক্রমশ শোচনীব হয়ে উঠেছে। দিনের পর দিন স্নান করি নি ‘পোশাক পরিবর্তন করি নি।এমন কি দিনের বরাদ্দ চার ঘন্টা ঘুমের সময়েও বুটজোড়া খোলার কথা মনে হয় না।গর্তে পড়ে আহত হলেন উইলি।তাঁকে নিয়ে আসা হল এডিনবার্গের ক্রেগলকহার্ট ওয়্যার হাসপাতালে । বিষণ্ণতায় ভরে আছে তাঁর মন । ষুদ্ধের গৌরবগাথা কত যে মিথ্যে,তা তিনি উপলব্ধি করছেন আজ।দেশরক্ষার ভার সৈনিকদের উপরে, অথচ তারা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন :
So secretly, like wrongs hushed up, they went They were not ours We never heard to which front they were sent.
সৈনিকের করুণ অপমৃত্যু দেখে বেদনাবিদ্ধ কবি বলেছেন , ‘
Was it for this the clay grew tall ?
বিখ্যাত স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডাঃ রিভারের সহযোগী ডাঃ ব্রুক দেখছেন তাঁকে । তিনি জেনেছেন যোদ্ধা হলেও উইলি আসলে এল কবি । তাই তিনি হাসপাতালের ‘হাইড্রা’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার দিলেন উইলিকে। এই পত্রিকায় উইলির তিনটে কবিতা প্রকাশিত হয় । অবশ্য কবিতাগুলিতে তাঁর নাম ছিল না ।এই হাসপাতালেই আলাপ হল সিগফ্রয়েড স্যাসুনের সঙ্গে । ইনি এক যুদ্ধবিরোধী কবি । গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল দুইজনের ।আলাপ হল আরও একজনের সঙ্গে। পরোক্ষভাবে ।তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রাচ্যদেশের এক কবি । নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন । হাতে এল ইংরেজি গীতাঞ্জলি। এই কবির কবিতায় তিনি পেলেন পরম প্রশান্তি । সেরে যেতে লাগল মনের অসুখ । হতাশার অন্ধকার সরে গিয়ে প্রত্যয়ের আলোয় ভরে উঠল মন । উইলির মনে হল হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও এই কবি কি করে যেন বুঝে ফেলেছেন উইলির মনের গোপন কথা ।যুদ্ধকালীন সেন্সারিংএর জন্য বইপত্র রাখার হুকুম নেই সৈনিকের কাছে । কিন্তু গীতাঞ্জলি থাকলে বড় ভালো হত । এতে আছে মাভৈঃ মন্ত্র । নাই নাই ভয় হবে হবে জয় । শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে মানুষ । উইলি তাঁর পকেটবইতে এই কবির দুটি লাইন টুকে রেখেছেন :
When I leave , let these be my parting words,What my eyes have seen , what my life received Are unsurpassable.
যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই,
যা দেখেছি, যা পেয়েছি , তুলনা তার নেই ।
দীর্ঘ ছয় মাসের চেষ্টায় ডাক্তাররা সুস্থ করে তুললেন উইলিকে । স্যাসুন তাঁকে যুদ্ধে ষেতে নিষেধ করলেন । যুদ্ধ সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়েছিলেন উইলি । তবু তিনি বন্ধুর কথা কেন শুনলেন না কে জানে ! স্যাসুনকে না জানিয়ে চলে গেলেন ফ্রান্সের যুদ্ধে ।একেই কি বলে নিয়তির অমোঘ আহ্বান !সাফল্যও লাভ করছিলেন তিনি যুদ্ধে । শুনছিলেন যে তাঁকে লেফটেনান্ট পদে উন্নীত করা হবে । কিন্তু তার আগেই শেষ হয়ে গেল তাঁর জীবননাট্য ।
১৯১৮ সালের ৪ নভেম্বর । রাত তখন তিনটে ।পূর্ব , পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসছে ইংরেজ বাহিনী । সামবর-ওয়াইজ খাল দখলমুক্ত করতে চায়তারা । জার্মান বাহিনীর হাত থেকে । ভোরের স্তব্ধতাকে খান খান করে গর্জে উঠল ব্রিটিশ ভাইকার্স মেশিনগান । খালের লকহাউজগুলোর উপর পাহারা দিচ্ছিল জার্মান রক্ষীরা । আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত তারা । ধাতস্থ হয়ে শুরু করল প্রতি আক্রমণ । গর্জে উঠল তাদের ম্যাক্সিম মেশিনগান আর মাউজার রাইফেল ।
বেলা বাড়ছে ।
রণকৌশল বদলালেন অধিনায়ক কর্নেল হাওয়ার্ড । ঠিক করলেন তিন দিক থেকে জার্মানদের ব্যস্ত রাখবে ইংরেজ বাহিনী । এই সুযোগে রয়্যাল সাসেক্সের ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিটের কিছু সেনা ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে খালে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়বে জার্মানদের উপর । এ পরিকল্পনা খুব সফল হল না । তাই অলআউট আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ।
উইলি যে দলে ছিলেন সেই দলের সৈন্যরা খাল অতিক্রম করে তীরে ওঠার সময়ে ম্যাক্সিম মেশিনগানের গুলি লাগল উইলির শরীরে । মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি । বুঝতে পারলেন শেষ সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। চোখের সামনে ভাসতে লাগল মায়ের মুখ । তাঁর শান্তি ও সান্ত্বনার শেষ আশ্রয় । আর মনে পড়তে লাগল প্রাচ্যদেশীয় কবির কবিতার লাইন ।
উইলি বা উইলফ্রেড আওয়েন শুধু যোদ্ধা নন । এক কবিও । জীবৎকালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর পাঁচটি কবিতা ।দুটি ‘নেশনে’ আর তিনটি ‘হাইড্রা’য় । আশা করেছিলেন পরবর্তীকালে প্রকাশ করবেন কাব্যগ্রন্থ। তার একটা ভূমিকাও লিখে রেখে গিয়েছিলেন । যার কিছু অংশ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে :
আমার এ বই বীরেদের জন্য নয়…………….
এই বইএর বিষয় যুদ্ধ , যুদ্ধের যন্ত্রণা … কবিতা যে এখন যন্ত্রণাবিদ্ধ My subject is war and the pity of war . The poetry is in the pity
আওয়েনের মৃত্যুর সাতদিন পরে শান্তি ঘোষণা হয় । সেই দিন তাঁর মায়ের কাছে প্রিয় পুত্রের মৃত্যু সংবাদ আসে । উইলির কবরের স্মৃতিফলকে কি লেখা হবে তা বলে দেন তাঁর মা । লেখা হবে উইলিরই কবিতার লাইন :
Shall Life renew these bodies ?of truth All death will be annul…….
( লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক )