বাংলাদেশের বনাঞ্চলে চাম কাঁঠাল বা চাপালিশ
সংগ্রাম দত্ত
সত্যবাণী: বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে চাম কাঠাল বা চাপালিশ। বলে বনাঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণীর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।চামকাঠাল এক ধরনের সুস্বাদু কাঁঠাল।বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলে এগুলো পাওয়া যায়।তবে বর্তমানে এই ফলটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।পাহাড়ে এলাকায় উৎপাদিত চাম কাঁঠাল শ্রীমঙ্গল শহরের বাজারে ইতিপূর্বে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হত। খেতেও খুব সুস্বাদু।এগুলোকে পাহাড়ি বা বন কাঁঠালও বলা হয়ে থাকে।মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল,কমলগঞ্জ,বড়লেখা,কুলাউড়া,জুড়ী ও হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট ইত্যাদি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত।ফলটির নাম ‘চাম কাঁঠাল’।দেখতে কাঁঠালের মতো হলেও আকারে অনেক ছোট। এর আকার অনেকটা ছোট বেলুনের মতো।এই কাঁঠালের কোষগুলোও ক্ষুদ্র। কিন্তু খুব সুস্বাদু। টক এবং মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে ‘চাম কাঁঠাল’। পাহাড়ি এলাকা ছাড়া এই গাছ টিকে থাকে না।ফলে সহজে এই গাছের দেখা মেলে না। এই ফলটির অন্যান্য বাংলা নাম- চাম কাঁঠাল’ চাম্বল, চাম্বুল, চাম, কাঁঠালি চাম্বুল ইত্যাদি।
চাম কাঁঠালকে ইংরেজিতে Monkey Jack বলে যার বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus chaplasha। এটি Moraceae পরিবারের উদ্ভিদ। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে প্রাকৃতিক অবস্থায় চাপালিশের বংশবৃদ্ধি সীমিত হয়ে গেছে।চাপালিশ উঁচু পত্রঝরা গাছ, ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে।ডাল ভাঙলে দুধের মতো ল্যাটেক্স বের হয়।গাছের কচি কাণ্ড রোম দিয়ে ঢাকা।বোঁটাযুক্ত,উপপত্র বড় এবং এটি কাণ্ডকে ঘিরে রাখে।চারা, চারার চেয়ে বড় গাছ এবং নতুন ডগার পাতা অনেক বড়।ফুল ও ফল আসে এপ্রিল থেকে আগস্টে। আবাসস্থল পত্রঝরা এবং চিরহরিৎ বন।
চাপালিশ হচ্ছে কাঁঠালের নিকটাত্মীয় একটি বুনো ফল। যা সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেখা যায়। এটি দেখতে অনেকটা কাঁঠালের মতো হলেও এর ফল কাঁঠালের চেয়ে ছোট এবং গাছের আকার আকৃতিও কিছুটা ভিন্ন।
চাপালিশ(Artocarpus chama) এর কচি ফল,এমনকি বীজেরও কিছু খাদ্য ও পুষ্টিগুণ রয়েছে। পরিপক্ক ফল সাধারণত হালকা টক-মিষ্টি হওয়ায় এতে প্রাকৃতিক শর্করা থাকে যা তাৎক্ষণিক শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। আঁশসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি হজমে সহায়ক এবং অন্ত্রে মল চলাচল সহজ করে। এতে ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়রন আছে, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাহায্য করে।এছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। কাঁঠালের মতোই এর বীজে প্রোটিন ও স্টার্চ থাকে যা ভেজে ও রান্না করে খাওয়া যায়।
চাপালিশ ফলের বীজ আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া যায়। স্বাদে আনেকটা চীনা বাদামের মতো। ফল হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এই গাছের কাঠ বাদামি, শক্ত, মজবুত, টেকসই ও মসৃণ। দরজা-জানালা, আসবাবপত্র এবং রেল পথের স্লিপার তৈরির জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়।বন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে চাপালিশের বীজ থেকে চারা ও গাছ জন্মায়। জুন-জুলাই মাসে সংগৃহীত পরিপক্ব ফল ৫ থেকে ৬ দিন রেখে দিলে পচে যায়। এ অবস্থায় পানিতে ধুয়ে বীজ বের করে পলিব্যাগে বপন করে বীজ তৈরি করা যায়। মৌলভীবাজারে প্রতিটি চাম কাঁঠাল ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।চাপালিশ, চামল, চাম্বল, চাম্বুল, টোপোনি (মগ), বলস্রাম (গারো), কাঁঠালি চাম বা চাম কাঁঠাল। যার ন বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Artocarpus chama ( আর্টোকার্পাস চামা)। মোরাসি পরিবারের কাঁঠাল-জাতীয় একটি বন্য প্রজাতির ফল।
বিপন্ন এই বৃক্ষটি বৃহৎ এবং পাতাঝরা প্রকৃতির। প্রায় কাঁঠালের মতো দেখতে তুলনামূলক ছোট আকৃতির এই ফলটিকে মানুষেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও বন্যপ্রাণীর খাদ্য হিসেবেই এটি প্রসিদ্ধ। এই গাছের কাঠ দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হওয়ায় আসবাবপত্র ও দরজা-জানালা সহ রেলপথের স্লিপার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।বাংলাদেশ সহ চীনের ইউনান, ভুটান, ভারত, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড পর্যন্ত এই গাছের বিস্তার রয়েছে।বাংলাদেশে মধুপুর বনাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি বন এবং সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে এই গাছ বেশি জন্মায়। এছাড়াও কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড় এলাকায়, ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ভালুকায় এবং ত্রিশাল উপজেলায় এবং ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। রাঙামাটি জেলা শহরে ৩১৬ বছরের বেশি বয়সী একটি চাপালিশ গাছ এখনও টিকে আছে।মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে একটি শতবর্ষী চাপালিশ ও হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে বলে জানা গেছে।ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ৩৫নং সেকশনে লাগানো চাপালিশের গাছ সংরক্ষিত অবস্থায় দেখা যায়। ময়মনসিংহের মধুপুরের রসুলপুরের বনে চাপালিশ গাছ আছে।এ ছাড়া ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সামনে কয়েকটি চাপালিশ গাছ রয়েছে।পাহাড় ঘেরা শহর রাঙামাটির জেলা প্রশাসকের বাংলোর প্রবেশ পথের পাশেই ৩১৮ বছরের পুরনো একটি চাপালির গাছ রয়েছে। গাছটির দৈর্ঘ্য ১০৩ ফুট এবং পরিধি ২৫ ফুট।বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে চাপালিশ কাঁঠাল বা চাম কাঁঠাল বন্যপ্রাণীর মধ্যে বানর, হনুমান, উল্লুক, এবং গন্ধগোকুল জাতীয় প্রাণীর প্রিয় খাদ্য। এছাড়াও, চাপালিশ ফল হাতি এবং অন্যান্য প্রাণীও খেয়ে থাকে।