সুবোধ পালের জন্মোৎসব: নতুন প্রজন্মের কাছে একাত্তরের ইতিহাস পৌছে দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন উদযাপনের বিকল্প নেই

সিলেট করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী

সিলেট: বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবোধ চন্দ্র পালের ৮০তম জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, নতুন প্রজন্মের কাছে একাত্তরের  ইতিহাস পৌছে দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন উদযাপনের বিকল্প নেই।

শনিবার ১০ই ফেব্রুয়ারি কানাডা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সুবোধ চন্দ্র পালের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সিলেটের গ্রামের বাড়ীতে স্বজনদের উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন বক্তারা।

সুবোধ পালের স্কুল পড়ুয়া নাতনী মৌরি দে’র উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত উৎসবের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা নানার জীবনীও তুলে ধরে মৌরি নিজে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ও যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বাংলা গণমাধ্যম সত্যবাণী’র সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা। বিশেষ অতিথি ছিলেন কানাডা প্রবাসী কমিউনিটি নেতা মানুপুরবী হালদার ও সিলেট জেলা ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা রুহুল কুদ্দুস বাবুল। বক্তব্য রাখেন, কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক গোপেন দেব ও মুক্তিযোদ্ধা সুবোধ পালের ভাগিনী জামাই লিটন দে প্রমূখ। সুবোধ পালের পরিবার সদস্য ও স্বজন ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানে সুবোধ পালের দুই নাতনী রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা ও নাটকের একটি ছোট্ট অংশ উপস্থাপন করেন।

বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুবোধ পালের নাতনী মৌরি দে তাঁর নানার জীবনী উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ১৯৪৪ সালের কোন এক সময় যে শিশুর আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হয়েছিলো এই ধরণীতল, সেই শিশুই যে এক সময় দুনিয়া কাঁপানো ঘটনার অংশ হবেন তা কি কেউ ভেবেছিলো? শিশুটির নাম সুবোধ,পুরো নাম সুবোধ চন্দ্র পাল। পিতা স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র পাল ও মাতা স্বর্গীয় হেমাঙ্গীনি পালের কোল জুড়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের সেনগ্ৰামের এই জীর্ণ কুটিরে জোৎস্নার চাঁদের আলোয় আলোকিত করে এই দম্পতির প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন সুবোধ পাল। জন্মের পর হতেই গ্ৰামীণ আবহে বৃহৎ পারিবারিক পরিমণ্ডলে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন তিনি।একে একে এই দম্পতির ঘরে আরো দুটি সন্তান (সুবল চন্দ্র পাল ও রীনা পাল) জন্মগ্ৰহণ করেন। তারপর একটি সময় বৈরাগী বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে জালালপুর হাইস্কুল থেকে ৫ম-৮ম শ্রেণী পর্যন্ত।

৮ম শ্রেণীতে পড়ার মধ্যে সুবোধ পালের জীবনে এক মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৫৭ সালে ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে তিনি পিতৃহারা হন। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে পুরো পরিবারের দায়িত্ব পড়ায় তাঁর জীবন সংগ্রামে এক বিরাট ঝড় বাহিত হয়। লেখাপড়া ছেড়ে ক্ষেতে-খামারে কাজ করে পরিবারের ব্যয় বহন করতে গিয়ে তাঁর পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে প্রভাতের সূর্যের আলোর প্রত্যাশায় মায়ের প্রেরণা ও সহযোগিতায় আবার লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৬২ সালে এসএসসি পাশ করেন সুবোধ পাল। ১৯৬৪ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ হতে পাশ করেন এইচএসসি। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে এমসি কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম‌এসসি ডিগ্ৰি অর্জন করেন। তারপর শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন।১৯৬৯ সালে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভারতেশ্বরী হোমস কলেজে করেন অধ্যাপনা। ১৯৭১ সালে ভারতেশ্বরী হোমস কলেজ, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল অধ্যাপনা কালীন অবস্থায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিত সেখানে হামলা করলে সুবোধ পাল সেখান থেকে পলায়ন করে হেঁটে হেঁটে জামালপুর জেলায় অবস্থান নেন। সেখান থেকে শেরপুর দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু রাজাকারদের অবর্ণনীয় অত্যাচার, লুটপাটের ফলে সেখান থেকে ফিরে ময়মনসিংহ চলে যান। ময়মনসিংহের পরিবেশ পরিস্থিতি অবলোকন করে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হয়ে মারকুলী হয়ে শেরপুর আসেন। শেরপুর থেকে নিজ বাড়ীতে। পুরো পথের একমাত্র বাহন পায়ে হাঁটা। আসার পথে দেখতে পান যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেট কীনব্রীজ অতিক্রম করে কিততা, তেতলী ইউনিয়নের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলে। তা দেখে তাঁর মনের মধ্যে প্রতিশোধের চেতনা জাগ্রত হয়। বাড়িতে এসে তাঁর জেঠুত্ব দাদা(স্বর্গীয় ধীরেন্দ্র চন্দ্র পাল)এর সহিত পরামর্শক্রমে সবাই নৌকা করে বালাগঞ্জ হয়ে ভারতের সুতারকান্দি সীমান্তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং যাত্রা শুরু করেন। বিশাল বড় বাড়িতে থেকে যান  সুবোধ চন্দ্র পাল তাঁর ছোট ভাই সুবল চন্দ্র পাল, কাকা স্বর্গীয় নরেশ চন্দ্র পাল ও উত্তর বাড়ির শিক্ষক ধীরেন্দ্র বাবু। বাড়ি থেকে সবাই চলে যাবার পর ভোররাতে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার দ্বারা (তৎকালীন মন্ত্রী আজমল আলীর ভাতিজার নেতৃত্বে) সুবোধ পালের বাড়ির উপর হামলা হয়। বাড়িতে যারা ছিলেন তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। বাড়ির প্রচুর ধনসম্পদ লুন্ঠিত হয়।  পরবরর্তীতে ভারতের লোহারবন্দ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণ গ্ৰহন করেন তিনি। প্রশিক্ষণ গ্ৰহন করার পর বাংলাদেশের কুকিতল ক্যাম্পে যোগদান করেন সুবোধ পাল। সেখান থেকে ভারতের সোনাকিরা চা বাগানের সীমান্তে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নভেম্বরের দিকে তিনি সাধারণ গেরিলা প্রশিক্ষণ,লিডারশীপ ট্রেনিং, সিগন্যাল ট্রেনিং প্রায় তিনমাস প্রশিক্ষণ গ্ৰহন করেন। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ বাংলাদেশ -ভারত যৌথবাহিনীর সহিত পাকিস্তানের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। সেই সাথে সুবোধ পালদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কুলাউড়া দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেখান থেকে বরমচাল হয়ে আসেন সিলেটে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করার পর সিলেটের ব্লুবার্ড হাইস্কুলে স্থাপিত বিডিআর ক্যাম্পে অস্ত্র সমর্পণ করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধ শেষে পুনরায় অধ্যাপনায় যোগদান করেন সুবোধ পাল। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা আইডিয়াল কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে সিভিল এভিয়েশনে এরোড্রাম অফিসার হিসেবে ১৯৭৫ সালে যোগদান করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে সিলেটের চৌহাট্রস্থ স্বর্গীয় গিরীন্দ্র কুমার দে’র প্রথম কন্যা সন্তান ছন্দা পালের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুবোধ পাল। বিভিন্ন এয়ারপোর্টে ম্যানেজার পদে অত্যন্ত চৌকস অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এসময়। ১৯৯৪ সালে আমেরিকা ভিজিট করার পরবর্তী সময় ১৯৯৬ সালে কানাডা চলে যান তিনি। ২০০১ সালে চাকরি হতে অবসর নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন সুবোধ পাল। সুবোধ চন্দ্র পাল ও ছন্দা পাল দুই পুত্র সন্তানের জনক জননী। বড় ছেলে শুভ্র পাল কানাডার একাউন্টিং ফার্মে কাজ করেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছোট ছেলে সৌরভ পাল রেভিনিউ পোস্টিং,এডমিন্টন,কানাডায় কাজ করেন।

উল্লেখ্য,  বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবোধ চন্দ্র পাল ও তাঁর ছোটভাই সুবল চন্দ্র পাল দুজনই একাত্তরের রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। দুই ভাই একাত্তরে রনাঙ্গন কাঁপিয়েছেন, ছিলেন পাক হানাদারদের ত্রাস। দুজনই এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। উচ্চ শিক্ষিত দুইভাইই পেশায় ছিলেন এক সময় শিক্ষক। বড়ভাই সুবোধ পাল কানাডার মন্ট্রিয়েলে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটির কাছে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।

 

You might also like