অন্যরকম একটি অবিচুয়ারি (obituary)
মোহাম্মদ হরমুজ আলী
মৃত্যু-প্রস্তুতি জীবনের কঠিনতম বিগ্রহ। যে যাবে তারজন্য যেমন, যাদেরকে এ যাওয়া দেখতে হবে তাদের জন্যও তেমনি। আমরা কি আদৌ সে প্রস্তুতি নিতে পারি – পারিনা! পারলে গত দু’দিন থেকে এমন অসাড় বসে আছি কেনো! গত কয়েক মাস থেকেই যখন এ যাত্রা অনিবার্য হয়ে উঠলো তখন থেকেই কেবল চেয়ে চেয়ে থাকা একে অপরের চোখে – নির্বাক, নির্জীব, অন্তহীন।
আজকের আমি, এই যে রাজনীতি করছি, সংস্কৃতি করছি, সমাজকর্ম করছি, এর ধারণা-বোধ যে মানুষটি আমার মধ্যে প্রোথিত করেছিলো, সে আলম। পুরো নাম শামসুল আলম। ভাগিনা-ভাতিজা-বন্ধু, মন ও মননের নিকটতম জন। অধ্যাপনা দিয়ে জীবন শুরু করা আপাদমস্তক রাজনীতিক। তার ধ্যান-জ্ঞান শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন, এক পলকের জন্যও বিচ্যুত হয়নি সেই আমৃত্যু স্বপ্ন থেকে। ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মফস্বলের সিলেট পর্যন্ত ক্লান্তিহীন পরিভ্রমণ করেও অতৃপ্তিই তার চিরসঙ্গী ছিলো। আজ এটা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবেনা (এ মতটি আমার একেবারেই নিজস্ব) যে বাংলাদেশের বাম রাজনীতির দুঃখজনক বাঁক পরিবর্তন আর কৌশলগত দৈন্যতাই হাজারো শামসুল আলমদের আক্ষেপের কারণ হয়ে উঠেছিলো।
মেধাবী পিতার আকস্মিক অসুস্থতা শিশু শামসুল আলমের পৃথিবীতে যে ভূমিধস বিপর্যয় ঘটায় নিজ সন্তানদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা তার সেই মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণার কিছুটা হলেও প্রশমিত করে। বড়ো ছেলে শাহরিয়ার সামী – এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত), ছোটো ছেলে ডাঃ সলিল সৌরভ (যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত), একমাত্র মেয়ে মীম শাবিপ্রবিতে পড়ছে। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষিকা স্ত্রী, স্বামীর অসুস্থতার কারনে গতমাসে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন।
‘৬৯এ ছয় দফা-এগারো দফার গণ অভ্যুত্থান কালে আমাদের অঞ্চলে আমারমতো অনেকেরই শ্লোগানে হাতেখড়ি – ছাত্রনেতা তখন শামসুল আলম। রাজনীতি বুঝিনা তবে এটা বুঝি যে একটা কিছু হতে যাচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আলমদের একটি দল ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েও বর্ডার ক্রস করতে পারেনি। এই পুরো সময়টা জুড়ে তরুণ সংগঠক হিসেবে তাকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম আফরোজ মিয়া সাহেবের উদ্যোগে মুক্তিবাহিনীর এক কমান্ডারের অধীনে স্থানীয়ভাবে কিছুদিন আমাদের এলাকায় অন্যান্যদের সাথে ট্রেনিং নিতেও দেখেছি।
‘১৯৭৪ সাল। সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলার পসার ঘটাতে আবারো শামসুল আলমই বার্তা নিয়ে এলো। গঠন করতে হবে সংঘ বা ক্লাব। সবাইকে একাট্টা করে গড়ে তুললো ‘পূরবী তরুণ সংঘ’, নামটাও তার দেয়া। সংঘ বা ক্লাবের সাথে আমাদের অঞ্চলের মানুষের এই প্রথম পরিচয়।
১৯৮০ সাল। সদ্য মাস্টার্স করা শামসুল আলম উদ্যোগ নিলো এলাকায় একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করবে। কয়েকজন বন্ধুবান্ধবও জোটালো যারা তার সাথে পাশ করেছে এবং বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করবে যতদিন সম্ভব। গ্রামের তিন পাড়ার বৈঠক হলো – কলেজ হলোনা। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে বেড়াতে এসেও চেষ্টা করেছে, এবার সিদ্ধান্ত হয়েছে কিন্তু কলেজ হয়নি। মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে কাবু হওয়া পর্যন্ত ঐ কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তার পিছু ছাড়েনি।
তার প্রথম কর্মক্ষেত্র তাজপুর কলেজ। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে গণ সংগঠনে অভিষেক। বালাগঞ্জ-ওসমানী নগর সহ বৃহত্তর সিলেটে উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, ক্ষেতমজুর সমিতি এবং মূল সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে কী প্রাণান্ত চেষ্টা। সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি কোনোকালেই সহজ ছিলোনা, এখনো নয়। খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন তার অধরাই থেকে গেলো।
গত কয়েক বছর থেকে আওয়ামী রাজনীতির একধরনের সমর্থক হয়ে উঠে আলম। বিশেষকরে ২১শে আগষ্ট আর ১/১১’র পর থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পাদন তার এই সমর্থনকে আরো সংহত করে। শফিক চৌধুরী (সাবেক সাংসদ) সবসময়ই চাইতেন আলম আমাদের রাজনীতিতে আসুক, এমনকি বঙ্গবন্ধু পরিষদে কাজ করার আহবানও তিনি জানিয়েছিলেন। আলম আমাকে একদিন বলেছিলো – মামা, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি আমার বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমনকি বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার রাজনীতিও আমি সমর্থন করি কিন্তু তোমাদের দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমি বুঝিনা, যার জন্য ঝুঁকি নিতে সাহস পাইনা। আমি টিপ্পনী কেটে বলেছিলাম – খালিক ভাই (আব্দুল খালিক মায়ন) বুঝলেন, নাহিদ ভাই (নুরুল ইসলাম নাহিদ) বুঝলেন, শুধু তুমিই বুঝার বাইরে থেকে গেলে!
কুয়েত ফেরত বাংলাদেশিদের স্বার্থ নিয়ে সরকারের সাথে দেনদরবারের সময় যারা তাকে কাছে থেকে দেখেছেন তারা স্বীকার করবেন যে তখন তাকে ওভারসিজ সেন্টারের মুখ্য কর্মকর্তা মনেহয়নি, মনেহয়েছে কোনো শ্রমিক নেতা তার সহকর্মীদের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন নিজের ভালোমন্দের তোয়াক্কা না করে! রাজনীতি অন্তপ্রান মানুষটি যেনো বহুদিন পর তার আসল কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাকে তখন বিষফোঁড়া মনে করতো।
বিগত প্রায় চার দশক ধরে সিলেট শহরের প্রতিটি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে শামসুল আলম কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলো। অটুট বিশ্বাস আর নিষ্ঠা ছাড়া এতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া যায়না।
আলমের কাছে আমার ব্যক্তিগত ঋণের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। বাঙালির নবজাগরণের বছর ৫২তে জন্ম নেয়া আলম ৭০ বছরের এক অতৃপ্ত জীবন নিয়ে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি নিশ্চিত, তার মতো একজন ভালো মানুষ সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য পাবে।
লেখক: রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মী