অবসরে গেলেন বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক
একাডেমিক ও অবকাঠামগত সমৃদ্ধি অর্জনসহ শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি
সিলেট করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী
সিলেট: সাদা গাড়ি পুষ্পে আচ্ছাদিত। কারো হাতে ফুল, কেউ নিয়ে এসেছেন মানপত্র, কেউ একজন আবার পোর্ট্রেট এঁকে এনেছেন, অনেকেই আবার নিয়ে এসেছেন নানা ধরনের উপহার সামগ্রী।
সবকিছু ছাপিয়ে সহকর্মীদের ভালোবাসা আর অশ্রু সজল চোখ ও আবেগঘন অনুভূতি প্রকাশের মধ্যেই বিদায় নিচ্ছেন এক নিভৃতচারী শিক্ষক। ধীর পায়ে গাড়িতে উঠছেন তিনি। পেছনে পড়ে রইল তার দীর্ঘ ২১ বছরের প্রিয় কর্মস্থল। ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সমাপ্ত করে অবসর নিয়ে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালেন বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক। মন মানে না বলে কয়েকজন শিক্ষক বরমচাল কলেজ থেকে কুলাউড়ায় বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন তাকে। আর তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এক স্বর্ণালী যুগের সমাপ্তি হল। তবে তার শিক্ষা ও আদর্শ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
১৯ মার্চ বুধবার অধ্যক্ষ ফজলুল হক শেষবারের মত তার দায়িত্ব পালন করলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে তিনি অবসর গ্রহণ করলেন বলে মন্তব্য তার কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের। তার বিদায় উপলক্ষে কলেজ মিলনায়তনে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ পর্বে বক্তারা বলেন অধ্যক্ষ ফজলুল হকের অবদান আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বক্তারা তার শিক্ষা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং অবসর জীবনের জন্য শুভকামনা জানান। আর বিদায়ী বক্তব্যে অধ্যক্ষ ফজলুল হক সকলের প্রতি দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। একই সাথে তিনি বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।
বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ছিল অধ্যক্ষ ফজলুল হকের ২১ বছরের কর্মস্থল। সততা নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সাথে কর্ম সম্পাদনে তার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অধ্যক্ষ ফজলুল হকের জন্ম ১৯৬৫ সালে। তার পৈত্রিক নিবাস কুলাউড়া উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের রাউৎগাঁও গ্রামে। তার পিতা মোঃ আব্দুল মালিক ছিলেন সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মাতা আক্তারুন নাহার খানম গৃহিণী। পিতার চাকুরির সুবাদে তিনি চুনারুঘাট উপজেলার রাজারবাজার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্টাফ কোয়ার্টারে জন্মগ্রহণ করেন। রাউৎগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষা জীবন শুরু করেন এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত রাউৎগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৮০ সালে নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৮২ সালে কুলাউড়া ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি এবং ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যা বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে ফজলুল হক ১৯৮৯ সালে বড়লেখা ডিগ্রী কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার এক বছর পর ১৯৯০ সালে তিনি উক্ত কলেজে প্রভাষক পদে স্থায়ীভাবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ওই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজ, কুলাউড়ায় যোগদান করে ২০০৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এই সময় বেশ কিছু দিন তিনি সী বার্ড কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০৪ সালের জুন মাসে তিনি বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে দীর্ঘ ২১বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যক্ষ ফজলুল হক শিক্ষকতার পাশাপাশি পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সফলভাবে তার অবস্থান অক্ষুন্ন রাখেন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস) কুলাউড়া উপজেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কুলাউড়ায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম মহিলা কলেজ ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীতে কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একই সাথে এপেক্স ক্লাব অফ মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিকের সভাপতি ছিলেন। ফজলুল হক কুলাউড়ার দক্ষিণ মাগুরা জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সেক্রেটারি ছিলেন এবং মসজিদ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ফজলুল হক ছাত্র জীবনে সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারাবরণও করেন। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থাকলেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থেকে অব্যাহতি নেন। তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের শাখা সংগঠন লাল সূর্য খেলাঘর আসর কুলাউড়ার একাধিকবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য তার খেলাঘর এর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে কুলাউড়ার শিশু কিশোররা জাতীয় পর্যায়ে একাধিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচির কুলাউড়া শাখার সভাপতি হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পালন করছেন।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই ফজলুল হক কুলাউড়া শহরের দক্ষিণ মাগুরায় স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্যক্তিগত জীবনে পিতা-মাতার সেবায় তিনি ছিলেন অন্ত:প্রাণ, তার পিতা মাতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সাথেই ছিলেন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের পিতা। তার স্ত্রী রহিমা সুলতানা শেফা কুলাউড়া সরকারি কলেজের শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশায় তারা যেমন সফল তেমনি পারিবারিকভাবেও সন্তানদের সেভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের বড় মেয়ে ডাক্তার মাশিয়াত পূর্বা কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাস করে বর্তমানে জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ইনডোর মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট মেয়ে মানতাকা পৌষি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রী এবং শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে তারা শিক্ষা জীবনে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় বৃত্তি অর্জন করে এবং উপজেলা জেলা বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে ফজলুল হক সবার বড়। তিন বোন দেশেই আছেন। তার একমাত্র ছোট ভাই ইফতেখারুল হক পপলু যুক্তরাজ্য প্রবাসী। তিনিও ছাত্র জীবনে এক সময় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কুলাউড়া, মৌলভীবাজার, সিলেট ল কলেজ এবং সর্বশেষ ছাত্র ইউনিয়ন সিলেট জেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের প্রয়োজনে ছাত্র সমাজের মৌলিক দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে এক সময় তিনি কারাবরণও করেন।বর্তমানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য । একই সাথে তিনি একুশের প্রভাতফেরী আয়োজন পরিষদ লন্ডন যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক এবং অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অধ্যক্ষ ফজলুল হক সততা নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, সহকর্মীদের প্রতি ছিলেন সংবেদনশীল, আর অভিভাবকদের কাছে ছিলেন পরম আস্থাভাজন। ২১ বছরের পথ পরিক্রমায় দেশের নানাবিধ সংকটে তার নৈতিক সততার কারণে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ও সততা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় কিছু জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সদস্য সহ সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় তিনি তার প্রতিষ্ঠানের ঐক্য, সংহতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিমন্ডলেও ফজলুল হক অত্যন্ত সৎ, অমায়িক, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল বলে সবার কাছে সমাদ্রিত। জীবনের নানা ঘাত প্রতিভঘাত যেমন তাকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা তাকে কোমলতর মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সৎ এবং নিবিষ্টচিত্তে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন কোন কিছু পাওয়ার আশা না করেই। কিন্তু বিদায় বেলায় সহকর্মীদের ভালোবাসা তাঁর এত বছরের পরিশ্রমের সার্থকতা প্রমাণ করে। অবসর গ্রহণের সময় দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার অসংখ্য শিক্ষার্থী, দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভালোবাসাই হয়তো তার অবসর জীবনের পাথেয় হিসেবে সুখের স্মৃতি হয়ে রইবে আমৃত্যু।