অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার অকুতোভয় সেনাপতিকে হারালাম
আবু মুসা হাসান
অমর একুশের কিংবদন্তী গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত নয়। ৮৮ বছর বয়সে গাফ্ফার ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তবু তাঁর এই মৃত্যু দুনিয়াব্যাপী কোটি কোটি বাঙালির হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। গাফ্ফার চৌধুরী শুধু মাত্র একুশের অমর গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতাই নন, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কান্ডারি। তাই তাঁর মৃত্যুতে অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার একজন অকুতোভয় সেনাপতিকে হারালাম। গাফ্ফার ভাই যে ছিলেন আমাদের বাতিঘর, ভরসার স্থল, সকল অনুপ্রেরণার উৎস।
গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় অনেক দিনের। বাংলাদেশে থাকাকালেই আমি গাফ্ফার ভাইকে চিনতাম। তাই আজ অনেক স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালেই গাফ্ফার ভাইকে দেখেছি ‘দৈনিক জনপদ’ এর সম্পাদক হিসাবে। আমার মহসিন হলের সিনিয়র ভাই গোলাম মহিউদ্দিন খানও জনপদে কাজ করতেন। তাঁর কাছে দিলখুশায় দৈনিক জনপদ কার্যালয়ে যেতাম। তখন গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে কথা হতো।
আমার সাংবাদিকতার শুরু দৈনিক সংবাদ এ। পরবর্তীতে আমি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণের ঢাকাব্যুরো চীফ থাকাকালে গাফ্ফার ভাই লন্ডন থেকে ভাবীসহ ঢাকায় একবার এসেছিলেন। তখন চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ ও দৈনিক আজাদী যৌথভাবে গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিল। অবজারভার পত্রিকার সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার প্রয়াত আতিকুর রহমান ছিলেন তখন চট্টগ্রামের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদীর ঢাকাব্যুরো চীফ। আতিক ভাইয়ের সাথে গাফ্ফার ভাইয়েরও বেশ সখ্যতা ছিল। আতিক ভাই এবং আমি মিলে গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে যাওয়ার কর্মসূচী ঠিক করলাম।
জেনারেল এরশাদের শাসনামলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষুরধার লেখনী তখন খুবই পাঠক নন্দিত ছিল। গাফ্ফার ভাইয়ের বক্তব্য শোনার জন্য চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে সর্বস্তরের জনগণ ছুটে এসেছিলো। সবাই মুগ্দ্ধ হয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের বক্তব্য শুনছিলেন। এমন সময় ঢাকা থেকে খবর এলো যে ভাবীর শারিরীক অবস্থার আকস্মিক অবনতি ঘটায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গাফ্ফার ভাইকে রাতের ট্রেনেই ঢাকায় ফিরতে হবে। কিন্তু গাফ্ফার ভাই অনর্গল বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদিকে রাতের ট্রেন ধরতে হলে সময়ক্ষেপণ না করে বক্তৃতা বন্ধ করতে হবে। এ অবস্থায় আমি মঞ্চে গিয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে বল্লাম, জরুরী খবর আছে আপনাকে এখনই বক্তৃতা বন্ধ করতে হবে। গাফ্ফার ভাই দুই-তিন মিনিটের মধ্যে বক্তৃতার ইতি টানলে তাঁকে ভাবীর অসুস্থতার কথা জানালাম।
কিন্তু বিপাকে পড়লাম গাফ্ফার ভাইকে হল থেকে বের করে আনতে গিয়ে। ভক্তরা এবং তরুণ অটোগ্রাফ শিকারিরা তাঁকে ঘিরে ধরলো। তবে ভক্তদের ভীড় ঠেলে কোনক্রমে গাড়ীতে উঠিয়ে যথাসময়ে তাঁকে নিয়ে ঢাকার ট্রেনে উঠলাম।
‘হাসানের বড় ভাই আমার ছোট ভাই’
দু’হাজার সালের জুন মাসে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনে মিনিস্টার প্রেস পদে যোগদান করার পরপরই আমি লন্ডনের সাংবাদিকদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য সবাইকে ব্রিকলেনের তৎকালীন স্পাইস রেস্টুরেন্টে দাওয়াত দিয়েছিলাম। তখন মাত্র ৫টি সাপ্তাহিক কাগজ ছিল- জনমত, সুরমা, নতুন দিন, পত্রিকা এবং সিলেটের ডাক, আর ছিল বাংলা টিভি। গাফ্ফার ভাইকে দাওয়াত দেয়ার জন্য ফোন করলাম। কিন্তু তিনি আসতে অনীহা জানালেও পরেবিশেষ অনুরোধে রাজী হলেন।
অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাই বল্লেন, হাসানের কথা আর কি বলবো, ওর বড় ভাই হচ্ছে আমার ছোট ভাই (সাংবাদিক এন এম হারুন)। হাসান একজন প্রফেশনাল সাংবাদিক, আশা করি সে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে, আপনার সবাই ওকে সহযোগিতা করবেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আলোচনা সভা
দু’হাজার সালের ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে তৎকালীন বাংলা টিভি বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি টক শো আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করেছিলেন ঊর্মি মাজহার। আলোচক হিসাবে ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আব্দুল মতিন, গাফ্ফার ভাই, ক্রয়ডন কাউন্সিলের সাবেক মেয়র ড. শফি খান এবং আমি। সবার প্রাণবন্ত ও সাবলীল আলোচনা রেকর্ড করতে গিয়ে দেখা গেল যে প্রায় তিন ঘন্টা রেকর্ডিং হয়ে গেছে। পরে ঊর্মি মাজহার ফোন করে আমাকে জানালেন এডিট করে কমাতে হবে। আমি গাফ্ফার ভাইয়ের বক্তব্য কাটছাট করতে সাহস পেলামনা, গাফ্ফার ভাইকে রাজি করালাম তিনি সহ এডিট করবো। যেদিন বাংলা টিভিতে যাব, সেদিনই ছিল জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আলোচনা সভা। ঐ সময় সংসদের কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত আব্দুল মান্নান সোহরাব আলী। মনুম্যান্ট স্টেশনের নিকটবর্তী ফিলপট লেইনে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান ভাইয়ের রেস্টুরেণ্টে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল।
গাফ্ফার ভাইকে বল্লাম, বাংলা টিভিতে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আলোচনা সভা হয়ে যাব। গাফ্ফার ভাই প্রথমে বল্লেন, আমাকে ওরা দাওয়াত দেয়নি। কিন্তু পরক্ষনেই বললেন, ঠিক আছে। বঙ্গবন্ধুর ওপর আলোচনা সভায় দাওয়াত না পেলেও আমার যেতে আপত্তি নেই।
‘ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে হলে ব্রডব্যান্ড লাগবে’
গাফ্ফার ভাই প্রতি সপ্তাহেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কলাম লিখতেন। একারনে তাঁকে বাংলাদেশের কোথায় কি ঘটেছে তা জানার জন্য প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের বন্ধুদের সাথে দীর্ঘসময় ধরে ফোনালাপ করতে হতো। আর প্রতি সম্তাহে ফ্যাক্সের মাধ্যমে এসব দীর্ঘ লেখা বাংলাদেশের একাধিক দৈনিক পত্রিকায় পাঠাতে হতো। গাফ্ফার ভাইয়ের এই বিড়ম্বনার অবসান ঘটানোর জন্য আমি তাঁকে কম্পিউটার এবং ইমেইল ব্যাবহার করার পরামর্শ দিলাম। এবং তাঁর বাসায় গিয়ে খুব সহজ পন্থায় কিভাবে কম্পিউটার ব্যাবহার করতে হয় ও লেখা টাইপ করতে হয় তা দেখিয়ে আসার প্রস্তাবও দিলাম। গাফ্ফার ভাই খুব সানন্দে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বললেন, আমার ভালো কম্পিউটার আছে ইমেইল এড্ড্রেসও আছে। আমি বললাম, কম্পিউটারে কলাম লিখতে এবং লেখা ইমেইলে পাঠাতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। তবে ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকা পড়তে কোন প্রশিক্ষণ লাগবেনা। আমি কম্পিউটারে সবকিছু সেট করে দেব।
দিন-তারিখ ঠিক করে গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় গেলাম। অন করে ঢাকার পত্রিকাগুলোর লিংক ওপেন করতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। শুধু বাফারিং হচ্ছে, কোন কিছুই ওপেন হচ্ছেনা। বুঝতে পারলাম যে ইন্টারনেটের সমস্যা। বিনীতভাবে গাফ্ফার ভাইকে বললাম, আপনার ব্রডব্যান্ড কানেকশন লাগবে। স্কাই থেকে ব্রডব্যান্ড কানেকশন নিয়ে আমাকে খবর দেবেন। চলে আসার সময় ভাবী বল্লেন, আপনি শুধু শুধু কষ্ট করবেননা, উনি কোনদিনই কম্পিউটার ব্যাবহার করবেননা। শিখার ইচ্ছা থাকলে ত’ ছেলে-মেয়েদের কাছে অনেক আগেই শিখতে পারতেন।
‘কদু নাই’
২০১৮ সালের সামারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমার ছোট বেলার বন্ধু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর হায়দার আলী খান লন্ডনে এসেছিলেন। তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। গাফ্ফার ভাইয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আমার শখের সব্জি বাগানের কর্জেট। কর্জেট হাতে দেয়ার পর গাফ্ফার ভাই খুশী হয়ে বল্লেন, কদু নেই। আমি বল্লাম, এবার কদু হয়নি, আগামী সামারে আপনার জন্য কদু নিয়ে আসবো। কদু নিয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় আর যাওয়া হয়নি।
গাফ্ফার ভাই ছিলেন একজন কিংবদন্তি মানুষ। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর এবং অমর একুশের গানের জন্য সবার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন।
আবু মুসা হাসান: মুক্তিযাদ্ধা সাংবাদিক, সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক।