বাংলাদেশ কি ধর্মীয় উগ্রপন্থার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চলেছে?
লেঃ ইমরান আহমেদ চৌধুরী, বি ই এম
ধর্মীয় বিশ্বাস নাকি রাজনৈতিক ইসলামের দখলদারি?
বাংলাদেশের সংবিধান ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, দেশটির আত্মপরিচয় বরাবরই বহুমাত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় পরিচিতিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দেশের মুক্তচিন্তা, গণতান্ত্রিক চেতনা ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় শত শত বছর ধরে সহাবস্থান করলেও, ধর্মীয় রাজনীতি দেশের ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে উঠছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো বহুত্ববাদী চেতনাকে ধ্বংস করে একধরনের “একপাক্ষিক ইসলামিক শাসন“ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত। হেফাজতে ইসলাম যখন ২০১৩ সালে ১৩দফা দাবি উত্থাপন করেছিল, তখন এর মধ্যে ছিল ব্লাসফেমি আইন চালু, নারীদের শিক্ষার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, এবং ইসলামী বিধিবিধান সংযোজনের দাবি। এ ধরনের উগ্রপন্থী আদর্শ শুধু বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী নয়, বরং দেশের সামগ্রিক সমাজ ওসংস্কৃতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ।
বাংলাদেশে উগ্র ইসলামী রাজনীতি কি টেকসই হতে পারে?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশে মাঝে মাঝে শক্তিশালী হয়ে উঠলেও, তাদের দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম।কেন?
গণতান্ত্রিক চেতনার গভীর শিকড়
বাংলাদেশের জনগণ একাধিকবার গণতন্ত্র রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমেছে। ১৯৯০–এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালের শাহবাগ গণবিক্ষোভ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনবিরোধী প্রতিবাদ—সবই প্রমাণ করে, দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। ইতিহাস বলে, উগ্রপন্থী দলগুলো কখনোই দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পায়নি।
অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সংযুক্তি
বাংলাদেশের রফতানি নির্ভর অর্থনীতি, গার্মেন্টস শিল্প ও রেমিট্যান্সদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। উগ্র ইসলামী রাজনীতির উত্থান হলে, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংকুচিত হবে এবং বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তান, ইরান এবং সিরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, ধর্মীয় উগ্রপন্থা অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয় এবং দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
রাজনৈতিক বাস্তবতা
যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সময়–সময় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে এসেছে, কিন্তু তারা কখনোই রাষ্ট্র ক্ষমতায় উগ্রবাদীদের আসীন হতে দেয়নি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় হেফাজতে ইসলামের নেতাদের ব্যবহার করা হলেও, পরবর্তীতে সরকার তাদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশের ইসলামিক মৌলবাদের ঝুঁকি
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চরমপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলোর উত্থান ও পতন লক্ষণীয়। আরব বসন্তের পর মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরে ক্ষমতায় এলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তালেবানদের পুনরুত্থান আফগানিস্তান কে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশও যদি একই পথে হাঁটে, তাহলে এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে উগ্রপন্থা বাড়লে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
️ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক: ভারত বরাবরই বাংলাদেশে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উত্থানকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখে। উগ্রপন্থার বাড়াবাড়ি হলে, ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।
️ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান: পশ্চিমা বিশ্ব ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদি বাংলাদেশ ধর্মীয় উগ্রপন্থার কবলে পড়ে, তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে।
️ চীনের কৌশলগত স্বার্থ: চীন সাধারণত ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনা, তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে, তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশ কি সত্যিই ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে?
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।বিশ্বের ২.১ বিলিয়ন মুসলিমদের মধ্যে আরব জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন মুসলমান নিয়ে এটি ইসলামী বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ইসলামপন্থীরা মনে করে, বাংলাদেশ একদিন ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে, বাংলাদেশের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো একটি গোঁড়া ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের পথে বড় বাধা।
একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দুটি স্তম্ভ প্রয়োজন – (১) আদর্শিক গ্রহণযোগ্যতা এবং (২) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা।
বাংলাদেশের জনগণের সুফিবাদী ইসলাম, বাঙালি সংস্কৃতি ও বহুমাত্রিক জীবনধারা কখনোই উগ্র ইসলামপন্থীদের সহজ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ দেবে না।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: কোন পথে এগোনো উচিত?
বর্তমানে বাংলাদেশ এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থান, অন্যদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।
১. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার
মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তরুণরা যাতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদী নীতি পরিহার
সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সুবিধাবাদী আচরণ করে। এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
সাধারণ জনগণের মধ্যে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মৌলবাদ ও সহিংসতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে।
৪. কঠোর আইন প্রয়োগ
হিযবুত তাহ্রিরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মের নামে সহিংসতা ছড়ানো গোষ্ঠীগুলোর অর্থায়ন ওকার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার: বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা কি হুমকির মুখে?
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ কখনোই চরমপন্থাকে সমর্থন করেনি, বরং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, শিক্ষার দুর্বলতাএবং বিদেশি উসকানি কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীকে টিকে থাকার সুযোগ দিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশ কি ১৯৭১ সালের আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?
গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা কি ধ্বংসের পথে?
বাংলাদেশ কি তালেবান শাসনের মতো পরিণতির দিকে যাচ্ছে?
এখনই সময় সচেতন হওয়ার। এখনই সময় নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে রক্ষার।
বাংলাদেশ কখনোই মৌলবাদীদের স্বপ্নের দেশ হতে পারে না—এটি নিশ্চিত করা সকল সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
লেখক পরিচিতি: লেঃ ইমরান আহমেদ চৌধুরী, বিইএম একজন গবেষক, লেখক ও সমাজসেবক।