আমলাতান্ত্রিক জটিলতা জেরে এনজিএফএফ-এর পরিত্যক্ত দেড়শ’ কোটি টাকার মালামাল অপসারণ হচ্ছে না
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত দেশের সবচাইতে প্রাচীন ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি (এনজিএফএফ) পরিত্যক্ত ঘোষিত হবার পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে কারখানার স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণ প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় কারখানাটির প্রায় দেড়শ কোটি টাকার মালামাল অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। একটি অসাধুচক্র কারখানার পরিত্যক্ত মূল্যবান মালামাল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার কারখানা ফেঞ্চুগঞ্জের ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরীটির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন কারখানাটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বিকল্প হিসেবে পার্শ্ববর্তী স্থানে নতুনভাবে স্থাপিত শাহজালাল সার কারখানার অধীনে এই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় জনবল ন্যস্ত করা হয়। বিসিআইসি’র ব্যবস্থাপনাধীন শাহজালাল সার কারখানাটি বর্তমানে পুরোদমে উৎপাদনে আছে।
অপরদিকে, বিলুপ্ত ঘোষিত এনজিএফএফ-এর স্টিল স্ট্রাকচার ও পরিত্যক্ত মালামাল স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় এই পুরাতন সার কারখানার স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণের লক্ষ্যে এনজিএফএফ স্ক্র্যাপ ডিসপোজাল কমিটি নামের উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ১০ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে। এই কমিটি সার কারখানাটির স্ক্র্যাপ মালামাল ৭টি শ্রেণীতে ভাগ পূর্বক মূল্য নির্ধারণ করে ৯৮,৮৫,৪৭,৫২৩ টাকা। পরবর্তীতে এই মালামাল বিক্রির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রথম দফায় আহ্বান করা এই টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হয় সিলেটের একটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আতাউল্লাহ। তারা ১০৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূল্যে কারখানাটির পরিত্যক্ত মালামাল কিনে নেয়। কিন্তু, পরবর্তীতে মেসার্স আতাউল্লাহ টেন্ডারের শর্ত পূরণ করতে না পারায় তাদের অনুকলে প্রদত্ত বিক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৫ মে এনজিএফএফ-এর স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণের লক্ষ্যে ২য় দফা টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এ টেন্ডারে মোট ১৪টি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান যথাযথ কাগজপত্র দাখিল করতে না পারায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত দরপত্র পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। এই ৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হয় ঢাকার মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স। তারা স্ক্র্যাপ মালামালের জন্য ১৩১ কোটি টাকা দর প্রদান করে। ১ম দফা দরপত্রের সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স আতাউল্লাহর চেয়ে ২য় দফায় প্রায় ২৮ কোটি টাকা বেশী মূল্য প্রদান করে। ফলে, বিগত ২০২১ সালের ৯ আগস্টে টেন্ডার প্রক্রিয় সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশের পাওয়ার যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট কমিটি।ফলে, টেন্ডারের যাবতীয় শর্ত পূরণ করে মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স সরকারের তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থও জমা দিয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ১০ সদস্যের কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ প্রদানের জন্য সুপারিশও প্রেরণ করেছে। কিন্তু টেন্ডার আহ্বানের প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে কার্যাদেশ পায়নি মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স।মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রহিম খান জানান, তারা সকল শর্ত পূরণ করে টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কমিটি তাদেরকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশও করেছে। কিন্তু, রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত তাদেরকে কার্যাদেশ বা ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হচ্ছে না। টেন্ডারের জন্য ইতোমধ্যে তার প্রতিষ্ঠান ৩ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার পে-অর্ডার দাখিল করেছে। যা গত এক বছর ধরে সরকারি তহবিলে জমা রয়েছে।এদিকে, দীর্ঘ ১ বছরেও স্ক্র্যাপ ডিসপোজাল কমিটির সুপারিশ মতে আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ না দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও দাখিল করা হয়। এই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদেরকে কারণ দর্শানোর নির্দেশও প্রদান করে। কিন্তু, এরপরও আমলতান্ত্রিক জটিলতায় ঝুলে আছে কার্যাদেশ প্রদানের বিষয়টি।
দীর্ঘ ১ বছরেও এনজিএফএফ-এর স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে নিয়মিত চুরি হচ্ছে পরিত্যক্ত মালামাল। ফলে, সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে শাহজালাল সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে জানান, ২য় দফা টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কাঙ্খিত মূল্য পাওয়া যায়নি। ফলে, ৩য় দফায় টেন্ডার আহ্বানের বিষয়টি বিবেচনা করছে মন্ত্রণালয়। তাই, সহসাই কাউকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া যাচ্ছে না। টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে স্ক্র্যাপ মালামাল চুরি যাওয়ার আশঙ্কা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।৩য় দফা টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে জানার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।তবে, স্থানীয় একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পরিত্যাক্ত এই সার কারখানার মালামাল নিয়মিত চুরি হচ্ছে। ফলে, সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় টেন্ডার প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে, সরকারের রাজস্বহানি হবে তত বেশী।