ইকবাল আহমদ চৌধুরীর জীবনাবসান

সিলেট করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী 

সিলেট থেকে: ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবীন রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী আর নেই। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন)। ২৯ জানুয়ারি শনিবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ১২ টা ২০ মিনিটে সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮২ বছর।
অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী ২ ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন। তাঁরাও বাবা মৃত্যুর আগেই মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রীও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগে। মৃত্যুকালে  ইকবাল আহমদ চৌধুরী দুই পুত্রবধূ ও দুই ছেলের দুই সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষিসহ অগণিত গুনগাহী রেখে গেছেন।

ইকবাল আহমদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন।কয়েকদিন আগে তাঁর শারিরীক অবস্থা অবনতি হলে তাকে নগরীর মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

ইকবাল আহমদ চৌধুরী ১৯৫৭ সাল থেকে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। সিলেটে আইয়ুবী সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ৬২র ছাত্রান্দোলনে ইকবাল আহমদ চৌধুরী ও প্রয়াত নেতা গুলজার আহমদ জুটি খুব পরিশ্রম করেন ও সিলেটে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। পরে ইকবাল চৌধুরী  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন এবং থাকতেন ইকবাল হলে। সে সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হয়ে ১৯৭০ সালে সিলেট জেলা বারের সদস্য হিসেবে আইন পেশায় যোগদান করেন সদ্য প্রয়াত ইকবাল চৌধুরী। এসময় তিনি ন্যাপ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিলেটে তার কুমার পাড়াস্থ বাসা ছিল ন্যাপ ও ছাত্র কর্মীদের এক আশ্রয় ।
ইয়াহইয়ার সামরিক শাসন বিরোধী লড়াইয়ে ও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্ষালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর করিমগন্জে ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের যুব ক্যম্প স্খাপনের সময় ইকবাল আহমদ চৌধুরী উদ্যোগী ভূমিকা নেন। এখানে  ক্যম্প স্থাপন হলে এটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মুক্তযুদ্ধ পরবর্তীকালে ইকবাল চৌধুরী সিলেট জেলা ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তী কালে তিনি একতা পার্টির সিলেটের নেতা ছিলেন। একতা পার্টি বিলুপ্ত হলে তিনি গণতন্ত্রী পার্টিতে যোগদান করেন। তিনি সব সময় নেপথ্য থেকে কাজ করতে পছন্দ করতেন।
সর্বশেষ  তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং গোলাপগন্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। তিনি দুবার গোলাপগন্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যন নির্বাচিত হন । মৃত্যুর সময় ও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক, নর্থ ইষ্ট বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সিলেটের যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি, হার্ট ফাউন্ডেশন, ডায়বেটিক এসোসিয়েশন, চক্ষু হাসপাতালসহ অসংখ্য সেবামুলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন ইকবাল আহমদ চৌধুরী।
তার দু পুত্র আসিফ ও আরিফ তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যু বরন করে। তার স্ত্রী ও তার জীবদ্দশায় পরলোকগমন করেন। তিনি দু পুত্রের দিকের দু নাতি রেখে গেছেন আর রেখে গেছেন অসংখ্য গুনগ্রাহী।

এদিকে, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ইকবাল আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঐক্য ন্যাপ সভাপতি পংকজ ভট্রাচার্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি এডভোকেট তবারক হোসেইন, নিউ ইয়র্ক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস, ঐক্য ন্যাপ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুল মোনায়েম নেহরু,  জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার সাবেক সাধারণ সম্পাদক, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব সৈয়দ জগলুল পাশা, নিউইয়র্ক প্রবাসী তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী, আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, নিউ ইয়র্কের লেখক সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, লুতফুর রহমান হেলাল, শেখ আখতারুল ইসলাম, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাহমুদ এ রউফ এবং লন্ডনে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সৈয়দ রকিবসহ অন্যান্যরা।

এক শোকবার্তায় ইকবাল আহমদ চৌধুরীর এক সময়ের আন্দোলনের সাথি পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, “ইকবাল আহমেদ চৌধুরী আর নেই আনাস পাশার কাছ থেকে এই দুঃসংবাদ জেনে মর্মাহত ও শোকাহত। বাষট্টির দুনিয়া কাঁপানো রক্তরঞ্জিত ইতিহাস, ১১ দফার গণছাত্র সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বদানে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গোলাপগঞ্জের জননন্দিত উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের সৎ জনপ্রিয় জননেতা হিসেবে সকল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণের প্রাণের মানুষ- কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল ইকবাল আহমেদের জীবন। গ্রামীণ নরনারীর জন্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মত দুঃসাহসিক কাজ করে নিজেকে চিরস্মরণীয় করে গেছেন জনমনেই।
আমার প্রায় ৬ দশকের সাথী-বন্ধু-সহকর্মী-সহযোদ্ধা ইকবালের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। আমার বিয়ের ঘটক ও পারিবারিক বন্ধু ছিলেন ইকবাল আহমদ চৌধুরী।  জননেতা বরুণ রায়, দেশব্রতী পীর হবিবুর রহমান, আবদুল হামিদ, তারা মিয়া, সরদার আঃ লতিফ, গুলজার আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ একঝাঁক দেশনায়কদের সাথে জনস্বার্থে-জাতীয়স্বার্থে-মুক্তিযুদ্ধে-দেশ গড়ার কাজে যে গৌরবময় অবদান রেখে গেছেন তিনি তা কোনদিন ভুলার নয়।
তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ইকবাল আহমদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানাই। শোকাহত আত্মীয়-পরিজন-ভক্ত-অনুরক্ত সকলকে জানাই সহমর্মিতা ও সহানুভূতি”।

 

 

You might also like