৭ই মার্চ উপলক্ষে যুক্তরাজ্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনা

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা

স্পেশাল করেসপনডেনট
সত্যবাণী

লন্ডন: একাত্তরের ঘাতক নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার আয়োজনে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উপলক্ষে ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ৬ই মার্চ সন্ধ্যায়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সৈয়দ এনাম ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রাজ এর পরিচালনায় ভার্চুয়াল সভায় বক্তা হিসাবে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মাহমুদ এ রউফ, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ড: শওকত আহমেদ এমবিই, বাচিক শিল্পী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এর সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ, সংগঠনের উপদেষ্টা হরমুজ আলী, সহ-সভাপতি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সহ-সভাপতি ⁠জামাল আহমদ খান, ⁠ সদস্য কাউন্সিলর জাসমীন চৌধুরী, সদস্য ড. হাসনীন চৌধুরী, সুইজারল্যান্ড শাখার সভাপতি খলিলুর রহমান, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ড. শাহ নেওয়াজ, চলচ্চিত্র পরিচালক এফ এম শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের সভাপতি শহীদ সন্তান প্রশান্ত পুরকায়স্থ বিএমই, যুবনেতা এডভোকেট আল আমিন প্রমুখ।
স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবি ও রাজনীতিবিদ মুজিবুল হক মণি, সাহিত্যিক মাহফুজা তালুকদার, ছড়াকার লুতফুর রহমান ও সংগঠনের সাধারণসম্পাদক জুয়েল রাজ।

অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সম্পাদক তাপস কান্তি বাউল, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনসার আহমেদ উল্লাহ, ৭ই মার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূর উদ্দিন আহমদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ঊর্মি মাজহার, সংগঠনের সহ সভাপতি মকিস মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাকীব, ⁠ সংগীতশিল্পী রীপা রাকীব, সাংস্কৃতিক সংগঠক বাচিক শিল্পী শাহাব আহমেদ ও কমিউনিটি নেতা ধনঞ্জয় পাল প্রমুখ।

সভার শুরুতেই যুক্তরাজ্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষে সহ-সভাপতি নিলুফা হাসান স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অন্য সহ-সভাপতি বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন আবৃত্তি করেন কবি নির্মলেন্দু গুণের ঐতিহাসিক কবিতা “স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো”। সেই কবিতার রেশ ধরেই মূল আলোচনায় সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান । ৭ই মার্চের ভাষণ ঢাকার বাইরে কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল সেই চিত্র উল্লেখ করেন সে সময়ে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ড: শওকত আহমেদ এমবিই। একই সাথে প্রবাসে সেই ভাষণকে কিভাবে নিয়েছিলেন প্রবাসীরা সেই বিষয়ে আলোচনা করেন তৃতীয় বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ বইয়ের লেখক মাহমুদ এ রউফ।
আলোচকরা তাঁদের বক্তব্যে একাত্তরের ৭ই মার্চের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন যে, পুরো দেশ এবং জাতি আসলে সেদিন অপেক্ষায় ছিল বঙ্গবন্ধু কি নির্দেশনা দেন। কারন ‘৭০ এর নির্বাচন ও এর ফলাফলই আসলে দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তাই ৭ই মার্চ এর ভাষণের পরে আসলে আমাদের লক্ষ্য অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল। তাই ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা। কারন এর মধ্যেই স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতির পিতা বিষয়গুলো নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এরপরে আসলে পিছনে ফেরার কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু
ইতিহাসের পরিক্রমায় নানা বিকৃতি, ব্যাক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রভৃতি নানা কারনে ৭ই মার্চ এর ভাষণ, বঙ্গবন্ধু এইসব বিষয় নিয়ে নানা যুক্তিতর্ক সামনে নিয়ে আসার যে অপচেষ্টা ইতিহাস তার আপন নিয়মেই এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করবে।

বক্তারা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এবং ইতিহাসকে মুছে ফেলার এক উৎসব শুরু হয়েছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান ৭ই মার্চকে মাহেন্দ্রক্ষণ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন ‘আমরা যারা সেই ময়দানে উপস্থিত ছিলাম আমরা তো জানি কি বার্তা নিয়ে সেদিন আমরা ঘরে ফিরেছিলাম। আমরা অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। কিন্ত আমাদের নেতা ছিলেন তখন শেখ মুজিব। এই সত্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ কিংবা কোন কারণ নাই।’

সভাপতি সৈয়দ এনাম ইসলাম বলেন, ৭ই মার্চ ১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেদিন রমনার রেইসকোর্সে নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। আমরা কি স্বাধীন হবো নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবো তা ঠিক হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর এদিনের সেই জগদ্বিখ্যাত ভাষণে। তখনকার হ্ঠকারি শক্তি যাদের অনেকেই ছিলেন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ তাদের কাছ থেকে প্রচন্ডরকম চাপ ছিলো সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার। তিনি ততটুকুই করেছেন যতটুকু প্রয়োজন বাঙ্গালী জাতি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির মালিকানা এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে। একটি শব্দও বলেননি যা অপ্রয়োজনীয়। বঙ্গবন্ধু জানতেন বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ব্যবস্থায় জাতিসংঘের সদস্য একটি দেশ ভেঙ্গে দেয়া কার্যত অসম্ভব সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিকভাবে অর্জিত জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া। জানতেন তাঁর ভাষণে বিচ্ছন্নতাবাদের তকমা লাগলেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা বিরাট হোঁচট খাবে। জানতেন তাঁর একটি কথা এদিক সেদিক হলেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চিহ্নিত হবে বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসাবে এবং রেইসকোর্স হবে জালিয়ানওয়ালাবাগ বা তিয়ান আনমেন স্কয়ার।

সৈয়দ এনাম আরো বলেন যে , আমরা যদি ৭ই মার্চের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ দেখি তবে এটা পরিস্কারভাবে বলা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার জন্য সঠিক দিন ছিল ২৬শে মার্চ, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক জেনোসাইড শুরু করার পর। একদিন আগেও নয়, একদিন পরেও নয়। ৭ই মার্চে স্বাধীনতা শব্দটি আপন করে নেয়া এবং যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যকার দুই সপ্তাহে একদিকে মানুষ পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পেরেছিল যুদ্ধের জন্য এবং স্বাধীনতা প্রোক্লামেশনের সাংবিধানিক শর্তগুলোও পূর্ণ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে উপজীব্য করে নির্মিত ‘মাইক’ চলচ্চিত্রের পরিচালক এফএম শাহীন বলেন এই ভাষণ পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পূনরুজ্জীবনে সহায়ক হয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা পুনরুদ্ধারে ৭ই মার্চের ভাষণ আবারও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত মাইক ছবি প্রদর্শিত হবে আগামী ২৭ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের জেনেসিস সিনেমা হলে। তিনি সবাইকে ছবিটি দেখার আমন্ত্রণ জানান।

You might also like