একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার তরুণ সমাজকে সঙ্গে নিয়েই সরকারকে জঙ্গী মৌলবাদীদের সাইবার জিহাদ প্রতিহত করতে হবে

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। আলোচনার বিষয় ছিল: ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গীদের জেহাদের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ: সরকারের করণীয়’। উক্ত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার। সভাপতিত্ব করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। ওয়েবিনারে ধারণাপত্র পাঠ করেন নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী ’জাগরণ’-এর যুগ্ম সম্পাদক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক মারুফ রসুল।

সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ব্লগার এন্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক-এর সভাপতি ড. কানিজ আকলিমা সুলতানা, নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’-এর যুগ্ম সম্পাদক সুইডেন প্রবাসী লেখক সাংবাদিক সাব্বির খান, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী গণজাগরণ মঞ্চ-এর সংগঠক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল, নির্মূল কমিটির আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লীনা পারভীন, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজম, তুরস্ক-এর সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল।

সূচনা বক্তব্যে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক আন্দোলনে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যে বলিষ্ঠ ইতিবাচক অবদান রেখেছে তা প্রতিবেশী অন্য কোনও দেশে সেভাবে দৃশ্যমান নয়। এই তরুণরাই স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে, ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শুধু নেতৃত্ব দেয়নি, জীবনও দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে পারে- তা আমরা ২০১৩ সালে বাংলাদেশের শাহবাগে দেখেছি, সমসাময়িক কালে যুক্তরাষ্ট্র, তিউনিসিয়া, মিশর ও তুরস্কে দেখেছি। অন্যদিকে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন দায়েশ বা আইএসআইএস-এর জেহাদী অভ্যুত্থান দেখেছি, যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে হলি আর্টিজান ক্যাফের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সরকার মাঠপর্যায়ে জঙ্গীদমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রদর্শন করলেও জঙ্গীদের সাইবার জেহাদ মোকাবেলায় তেমন কোনও অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। ইউটিউব ও ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজে সরকারের উচিৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সমাজের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আমাদের তরুণরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হতে পারলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেও তা পারবে। জনগণের, বিশেষভাবে তরুণ সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সাইবার যুদ্ধে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির জঙ্গী জিহাদ মোকাবেলা সম্ভব হবে না। সাইবার যুদ্ধ সার্বক্ষণিক। এই যুদ্ধ কোনও আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেশন মানে না। এই যুদ্ধে যেভাবে সর্বত্র জেহাদের ভাইরাস ছড়ানো হচ্ছে তার ফলে ইরাক ও সিরিয়ার মতো ভবিষ্যতে বিশ্বে বহু গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে।’

ধারণাপত্রে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক মারুফ রসুল বলেন, ‘সারা পৃথিবীতেই সাইবার জগৎ এতোটাই বিস্তৃত হয়ে পড়েছে যে, এখনই যদি এর লাগাম আমরা ধরতে না পারি, তো ভবিষ্যতে তল খুঁজে পাবো না। এজন্য এ বিষয়ে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর রাখা উচিৎ, যারা কেবল সাইবার জিহাদ মোকাবেলা করবেন তা-ই নয়, তার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন এবং এ বিষয়ে আইনি দিকগুলো মোকাবেলা করবেন। গণমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেইজ বা ইউটিউব চ্যানেলের কমেন্ট সেকশন বর্তমানে সাইবার জিহাদের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র, সেহেতু এ বিষয়ে সরকার একটি আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এ বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেই হবে। পদক্ষেপটি হলো- যেহেতু সকল গণমাধ্যমই নিজস্ব ফেসবুক পেইজ বা ইউটিউব চ্যানেল নিজেরাই অপারেট করে, তাই তাদেরকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল করে তোলা। অর্থাৎ এই নির্দেশনা রাখা যে, তাদের নিউজ লিংকের নিচের কমেন্ট সেকশনও তাদেরই দায়-দায়িত্ব। সেখানে যদি জঙ্গী তৎপরতা চালানো হয়, ভুল বা মিথ্য তথ্য ছড়ানো হয়, তবে সেই গণমাধ্যমকে আইনির মুখোমুখি হতে হবে। তাহলে গণমাধ্যমগুলোও এ বিষয়ে সতর্ক হবে। চাইলে তারা তাদের মন্তব্য সেকশনে করা কোনো জঙ্গী অপতৎপরতার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। বহু দেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সম্পর্কে আইন তৈরি করেছে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ফেসবুক, ইউটিউব যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান- এসব মাধ্যমের বিভিন্ন মৌলবাদী পোস্ট সম্পর্কে রিপোর্ট করলে তারা বলে- আমরা আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলি- এটি তো গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার। ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে। আগের চেয়ে ২০২১ সালে এসব মাধ্যমের সাথে আমাদের যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের মতো নিজেদের আইন অনুযায়ী এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চালানোর পর্যায়ে এখনও পৌঁছতে পারি নি। এক্ষেত্রে আমরাও সিঙ্গাপুরের মতো কঠোর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার জিহাদের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান এই যুদ্ধ রাজনৈতিক যুদ্ধ। রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা না করে শুধু রিপোর্ট করে এই সাইবার জিহাদ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। আমরা তাদের প্রতিহত করার মত সুসংগঠিত নই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখনও আমরা ডিজিটাল হতে পারি নি। এজন্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলো মনিটরিংয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দক্ষ রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। অনলাইনের এই রাজনৈতিক যুদ্ধ সম্মিলিতভাবে আমরা না করতে পারলে একসময় বাংলাদেশ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে চলে যাবে।

ধারণাপত্রে মারুফ রসুলের উত্থাপিত সুপারিশগুলো বিবেচনা এবং কার্যকরণের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সম্পর্কে বিরূপ কর্মকান্ড বা প্রচারণার রিপোর্টগুলো আসে। জঙ্গীবাদী, সাম্প্রদায়িক বা দেশবিরোধী তৎপরতার রিপোর্ট আমাদের কাছে আসে না। রাজনৈতিক বিষয়গুলো মনিটর বা রিপোর্ট করার মত কেউ নেই। এগুলো রিপোর্ট করার জন্য দক্ষ সংগঠিত রাজনৈতিক টিম গঠন করতে হবে।কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, সাইবার জগতের মাধ্যমেই বর্তমানে দেশবিরোধী, জঙ্গীবাদী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমাকে যে ছেলেটি আক্রমণ করেছিল, তার সাথে আমি পরবর্তিতে দেখা করেছিলাম। সে আমাকে বলেছিল যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই আমার ওপর আক্রমণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাই জঙ্গী মৌলবাদীদের সাইবার জিহাদ প্রতিরোধে সরকারকে অনুরোধ করি- আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক তরুণ প্রজন্মে সাইবার যোদ্ধাদের ডাকুন। যারা সাইবার জগতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সুনির্দিষ্ট মতামতের ভিত্তিতে সাইবার জিহাদ মোকাবেলায় কাজ করুন।’

ব্লগার এন্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক-এর সভাপতি ড. কানিজ আকলিমা সুলতানা বলেন, ‘গ্রামের ছেলেরা ধর্ম ও জঙ্গীবাদের পার্থক্য বুঝতে পারে না। তাদেরকে বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের ও মূল দায়িত্ব সরকারের। মামুনুল হকের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার একের পর এক প্রমাণের পর তার পক্ষের অনুসারীরা অন্ধ সমর্থন থেকে সরে আসছে। সরকারের দায়িত্ব বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, ইতিহাসভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে সাইবার জগতের জঙ্গী কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করা।নরসিংদীর একটি গ্রামে প্রত্যেক ল্যাম্পপোস্টে সাইনবোর্ড লাগানো আছে- এই গ্রামে গান-বাজনা নিষেধ। এই গ্রামে প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান নয়।প্রশাসনকে এজন্য সম্মিলিতভাবে এসব দৃশ্যমান জঙ্গীবাদী কার্যক্রম প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।’

You might also like