গাফ্ফার ভাই: ইতিহাসের এক কিংবদন্তী তথ্যভান্ডার

 নিলুফা ইয়াসমীন

অষ্টাশী বছরেও স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, বড় বড় কবিতা মুখস্ত আওড়িয়েছেন, পৃথিবীর সকল প্রান্তের খবর ছিল নখ দর্পনে, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ বললেও অত্যুক্তি হবেনা তাঁকে। এ যেন বিশ্ব ইতিহাসের এক তথ্যভান্ডার। হুইল চেয়ারে বসেও  বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন, চমৎকার বক্তব্য রেখে শ্রোতাদের  মুগ্দ্ধ করেছেন। আজ সবই অতীত। বিনম্র শ্রদ্ধা! প্রিয় গাফ্ফার ভাই।

স্কুল জীবনে কবিতা লেখা শুরু, কলেজে ছাত্র থাকাকালীন  সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি, মুক্তিযুদ্ধের কলম সৈনিক সারা জীবন সোচ্চার থেকে জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন গাফ্ফার ভাই। বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিষ্ট, সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, স্মৃতি কথা, ছোটদের উপন্যাসসহ প্রায় ৩০টির মত বই লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস হল ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’। সব কিছু ছাড়িয়ে অমর  হয়ে থাকবেন ’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ কালজয়ী গানটি লেখার জন্য।

বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে আশির দশকের শেষের দিকে গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সেই সময়ে তিনি ভাবীকে (সেলিমা আফরোজ) নিয়ে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার জীবন সাথী সাংবাদিক আবু মুসা হাসান গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাবেন শুনে আমিও জনপ্রিয় কলামিস্ট সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা। হাসানের সাথে আমি গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁরই এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আরেক গুণী ব্যক্তি গাফ্ফার ভাইয়ের কাজিন কবি আসাদ চৌধুরী।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন নির্বাহী সদস্য নিলুফা ইয়াসমীন। বক্তব্য রাখছেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার। মঞ্চে উপবিষ্ট সাবেক সচিব এম মোকাম্মেল হক এবং সাংবাদিক আবু মুসা হাসান।

অনন্য মাত্রার দুই কিংবদন্তি সাহিত্যিকের মজাদার আড্ডা তখন মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। বাসায় শাশুড়িমায়ের কাছে ছোট দুটি বাচ্চা রেখে গিয়েছি। ক্রমে রাত বাড়ছে, আমার সঙ্গী বারবার আমাকে তাড়া দিচ্ছেন বাড়ি ফেরার জন্য। কিন্তু আমি এতোটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম তাঁদের আলাপনে, উঠার তাগিদ অনুভব করছিলামনা। অনিচ্ছাসত্বেও মজার আড্ডা ছেড়ে সেদিন উঠতে হলো।

দু’হাজার সালে লন্ডন আসার পর গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় গিয়েছি, তিনি এসেছেন আমাদের বাসায় বহুবার। ঢাকা থেকে কোন পরিচিত জন বিশেষ করে সাংবাদিকরা আসলেই গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাইতেন। তাঁদের আগমন উপলক্ষে আমাদের বাসায় সব সময়ে গাফ্ফার ভাই আর আমাদের আরেকজন শ্রদ্বেয় প্রিয়জন সাংবাদিক প্রয়াত আমিনুল হক বাদশাহ ভাই অতিথি হয়ে আসতেন। আমার দুই ভাসুর সাংবাদিক এন এম  হারুন এবং জামাল হাসান গাফ্ফার ভাই এবং বাদশা ভাইয়ের ঘনিষ্ট  ছিলেন। সেই সুবাদে তাঁরাও ছিলেন আমার ভাসুর তূল্য ।

সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন গাফ্ফার ভাই। ‘বিলাতের আয়নায়’ শিরোনামে গাফ্ফার ভাইয়ের ধারাবাহিক কলাম পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল, সমসাময়িক ঘটনা গল্পের মত করে তুলে ধরতেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক কলাম লিখতেন। তৎকালীন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশার অনুরোধে গাফ্ফার ভাই পত্রিকার একুশে সংকলনের জন্য আরো একটি কালজয়ী কবিতা লিখেছিলেন, যা পত্রিকার আর্কাইভ খুঁজলেই পাওয়া যাবে।

গাফ্ফার ভাই ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই কলাম  লিখতেন। এত বড় বড় লেখা হাতে লিখতেই তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। সাপ্তাহিক পত্রিকা তখন প্রতি সপ্তাহে সোমবারে প্রকাশিত হতো, রোববার রাতে প্রেসে যেতো। শনিবারে ফ্যাক্স এর মাধ্যমে গাফ্ফার ভাইয়ের লেখা পাঠানোর সময় নির্ধারিত ছিল। অনেক সময়ে রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমার অন্যান্য সহকর্মী এবং পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে আমি শনি, রোববার গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় ফোন করে লেখা কখন পাবো খবর নিতাম। তবে, প্রায় অধিকাংশ  সময়ে ফোন ধরতেন সেলিমা ভাবী।

ভাবীর ব্যবহার ছিল খুবই চমৎকার। ফোন ধরে এতটা অমায়িকভাবে কথা বলতেন যা ভুলতে পারিনা। কুশল বিনিময়ের পর খুবই মায়া করে বলতেন, ‘মা কেমন আছে’, আমার আম্মার কথা তিনি জানতে চাইতেন, এমনভাবে বলতেন যেন তিনি তাঁর মায়ের খবর জানতে চাচ্ছেন। আজও ভাবীর সেই মধুরকন্ঠ কানে বাজে। আমি পত্রিকায় ‘ঘর মন জানালা‘ নামে পাঠকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতাম। সেই লেখা ভাবীর খুব পছন্দের ছিল, আলাপে উল্লেখ করতেন।

একবার ঢাকা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রায়ত এ বি এম মুসা লন্ডনে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি আমাদের বাসায় ছিলেন কিছুদিন। মুসা  ভাইয়ের সম্মানে আমাদের বাসায় অনেককে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। মুসা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন গাফ্ফার ভাইও অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। পরবর্তীতে আমাদেরকেসহ গাফ্ফার ভাই তাঁর  বাসায় মুসা ভাইকে দাওয়াত করেছিলেন। ভাবী অসুস্থ ছিলেন তাই আমি রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। গাফ্ফার ভাই বললেন, ‘তুমি রেঁধে এনেছো কেন, দুই মুসার জন্য তোমার ভাবী কত পদ রেঁধেছে  দেখ, আমি ইস্ট লন্ডন থেকে ইলিশ মাছ আর পুঁই শাক নিয়ে এসেছি, শেলী রেঁধেছে।’

সেদিন ইলিশ মাছ দিয়ে পুঁই শাক মজা করে খেলাম।

 ভাবী  হুইল চেয়ারে বসেই রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। আমি কাজে সাহায্য করতে চাইলে তিনি অনুমতি দেননি। ভাবী আমাকে তার বাসার বাগান দেখিয়ে বললেন, হুইল চেয়ারে বসে বাগান পরিচর্যা করেন। খুবই গুণী একজন মানুষ ছিলেন ভাবী। গাফ্ফার ভাইয়ের সকল ছাপার লেখা ভাবী যত্নসহকারে গুছিয়ে রাখতেন।

গাফ্ফার ভাইয়ের স্মরণ শক্তির কথা আগেই উল্লেখ করেছি, ইতিহাস ছিল তার ঠোঁটস্থ। তারপরও কোন কিছু জানতে তিনি বিভিন্ন জনের কাছে ক্রস চেক করতেন। মাঝে মাঝে হাসানকে ফোন করে কোন বিষয়ে জানতে চাইতেন। অনেক সময়ে হাসান উত্তর দিতে দেরী  করলে বলতেন, নীলুকে দাও। আমার মত একজন নগণ্য ব্যাক্তির  কাছে গাফ্ফার ভাই কোনো তথ্য যাচাই করতে চায় শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম।

সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে গাফ্ফার ভাই মাঝে মাঝে আসতেন। বিশেষ করে সামাদ ভাই (পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি)  বাথ থেকে লন্ডন এসেছেন শুনলে গাফ্ফার ভাই আসতেন।  আমাদের আড্ডার মধ্যমণি থাকতেন গাফ্ফার ভাই। অধীর আগ্ৰহে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনতাম সবাই।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হতো গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে। সত্যবাণীর সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশার বাসায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাই সব সময়ে আসতেন। আমরাও অতিথি হিসেবে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। গাফ্ফার ভাই তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে গল্প করতেন।  অনেক অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাইয়ের বড় বড় কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি শুনে অবাক হয়ে যেতাম।

কুশল জানার জন্য ফোনে কথা হলেই গাফ্ফার বলতেন বাসায় আসো। সব সময়েই বলেছি আসবো, কিন্তু গত দু’বছর যাওয়া হয়নি।

আগে যতবার গাফ্ফার ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন, প্রায়ই হাসপাতালে যেয়ে দেখে এসেছি। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও মনের জোর ছিল প্রবল। কথা বললে মনেই হতোনা তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ নন।

কয়েকদিন আগে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান ভাইকে বলেছিলাম, গাফ্ফার ভাই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেই দেখতে যাব। বাসায় যেয়ে গাফ্ফার ভাইকে আর দেখা যাবেনা। শুক্রবার আলতাব আলী পার্কে কফিন বন্দি অবস্থায় শেষবারের মত গাফ্ফার ভাইকে দেখলাম। সামনাসামনি দেখতে না পেলেও আমাদের হৃদয়ে গাফ্ফার ভাই চির জাগরুক থাকবেন।

লেখক পরিচিতিঃ নিলুফা ইয়াসমীন,বার্তা সম্পাদক সত্য বাণী। সাপ্তাহিক পত্রিকার সাবেক বার্তা সম্পাদক।

You might also like