ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী, টাকার মানের ধস: অর্থনীতির সংকট ও উত্তরণের পথ

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ গত কয়েক মাস ধরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবনতি এবং আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা এই সংকটের পেছনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আমদানি-রপ্তানির অসমতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস এবং বৈশ্বিক প্রভাবকে দায়ী করছেন। এই পরিস্থিতিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছে।

ডলারের দাম বৃদ্ধি ও টাকার দুর্বলতার মূল কারণ

১. রিজার্ভে ধস:

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৫-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এই রিজার্ভ ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় ৫৮% কম। রিজার্ভের এই সংকটের ফলে আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

২. আমদানি-রপ্তানির বিশাল ব্যবধান:

বর্তমানে দেশের মাসিক আমদানি ব্যয় ৭.৫ বিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে রপ্তানি আয় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। এই ব্যবধান মেটাতে প্রতিমাসে অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা তৈরি হচ্ছে, যা টাকার মানকে আরও দুর্বল করছে।

৩. রেমিট্যান্সে অনিয়ম:

প্রবাসী আয়ের প্রায় ৩০% এখনও হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। এতে সরকারি রিজার্ভে ডলার যোগ হচ্ছে না; বরং কালোবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ছে।

৪. বৈদেশিক ঋণের চাপ:

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে গত বছর ৪.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। এই ঋণের বোঝা রিজার্ভকে আরও সংকুচিত করছে।

৫. বৈশ্বিক অস্থিরতা:

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানো বৈশ্বিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে।

– দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস: সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৭৫ টাকা, চাল ১০০ টাকা কেজি এবং গ্যাস সিলিন্ডার ১,৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে। ওষুধ ও প্রযুক্তিপণ্যের দাম ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

– বেকারত্বের মেঘ: তৈরি পোশাক শিল্পে ইতিমধ্যে ৫০,০০০ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ইস্পাত ও প্লাস্টিক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নতুন করে কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছে।

– বিদ্যুৎ সংকট: ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানি কমে যাওয়ায় দেশজুড়ে দৈনিক ২-৪ ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে।

সমাধানের রূপরেখা: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

১. রপ্তানির নতুন খাত সৃষ্টি:

তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্স, জাহাজ নির্মাণ ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ. মনসুর। তার মতে, \”ভিয়েতনামের মতো আইটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে আমরা বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি।

২. রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিককরণ:

প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪% ইনসেনটিভ দেওয়া এবং হুন্ডি বাণিজ্য রোধে কঠোর নজরদারির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)।

৩. আমদানি বিকল্পীকরণ:

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন ৪০% বাড়ানো গেলে চাল আমদানি ৭০% কমবে। একইভাবে সোলার প্যানেল ও ইলেকট্রিক যানবাহন উৎপাদনে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ভর্তুকি দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

৪. জরুরি ভিত্তিতে সোনার রিজার্ভ ব্যবহার:

বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ টন সোনার রিজার্ভ বিক্রি করে ডলার কিনে রিজার্ভে স্বস্তি আনার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ

– প্রকল্প পুনর্বিন্যাস: মেট্রোরেলের দ্বিতীয় পর্যায় স্থগিত করে জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।

– স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য: রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে রুবল-রুপি বিনিময় চুক্তি সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

– সৌরশক্তিতে জোর: ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০% নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি সৌরপার্ক নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতির ভবিষ্যৎ: আশা-আশঙ্কার দ্বন্দ্ব

ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. সামসুল আলম বলেন, \”ডলারের এই সংকট একটি সতর্কবার্তা। এখনই যদি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের গুণগত পরিবর্তন না আসে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।\” অন্যদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, \”মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও হাইটেক পার্ক প্রকল্প শেষ হলে ২০২৬ সালের মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।ডলারের দাম ও টাকার মানের এই দ্বন্দ্ব কেবল অর্থনৈতিক সংকট নয়; এটি আমাদের উৎপাদননীতি, আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরীক্ষা। এই সংকট কাটাতে সরকার, বেসরকারি খাত ও সাধারণ মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টাই টেকসই সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে। সময় এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।সূত্র: জনমত

You might also like