ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ‘নক্ষত্র হওয়া’ এবং বিপরীত অবস্থান

 হামিদ মোহাম্মদ 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়াণের পর অনেকের মত আমি নিজেও লিখেছিনক্ষত্রপতন কিন্তু তিনি নক্ষত্র ছিলেন কিনা সেটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন একজন নির্লোভ আর্থিকভাবে সৎ ছিলেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য ভালো কিছু করার ব্যাপারে একজন জেদী লোক ছিলেন, এটা নি:সন্দেহে সত্য এর বিপরীতে রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রশ্নহীন ছিলেন না এর প্রমাণ, মৃত্যুর দুদিন আগেও তিনি একটি আলোচনা সভায় বলেছেন, বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেনমওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জোর দিয়ে বলতে গিয়ে পুরো নাম বলেছেন ভাসানীর তিনি বলেছেন, মার্চ নয়, ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নির্মাণের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করারএক নয়া ধান্ধা ইতিহাসকে পাল্টে দেয়ার জন্য এক দুইজনই যথেষ্ট সে কাজটিই তিনি করেছেন তাঁর কথাই বলে দেয় তিনি কে ছিলেন, কী লোক ছিলেন

আমার লেখা পড়ে অনেকেই বিরক্ত হবেন বিরক্ত হলেও সত্য কথাটিতো বলতে হবে কেননা, নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার দায়িত্ব যিনি নিলেন, ‍তিনি কী মানুষ তা তো পরিষ্কার করা দরকার জানাতে হবে কি করেছেন তিনি, আর তিনি কী চিন্তা করতেন

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকালে ডাক্তার হিসাবেফিল্ড বাংলাদেশ হাসপাতালপরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, এটা সত্য। জেনে রাখা ভালো, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যেকটি সেক্টরে একটি করে ফিল্ড হাসপাতাল ছিল আগরতলা প্রতিষ্ঠিত ফিল্ড বাংলাদেশ হাসপাতাল সবচেয়ে বড় ছিলএর পেছনের মূল কারিগর ছিলেন সেক্টর কমাণ্ডার খালেদ মোশাররফ ডা. জাফরুল্লাহ ডাক্তার হিসাবে প্রবাসী সরকারের নিকট থেকে বেতন নিয়েছেন। তবে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়

শুরু করি ১৬ ডিসেম্বর একাত্তর থেকে তাঁর ভূমিকার কথা দিয়ে ১৬ডিসেম্বর জেনারেল ওসমানী হেলিকপ্টার যোগে সিলেট অঞ্চলে আসতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন শেখ কামাল ডা. জাফরুল্লাহ। পথিমধ্যে হেলিকপ্টারে গুলি এসে পড়ে এই অবস্থায় সিলেট অবতরণ নাকরে তারা আগরতলায় পৌছেন। পরবর্তীতে জাফরুল্লাহ রঙ চং লাগিয়ে বলেনভারতীয়রা গুলি করেছিল অথচ, আশংকা করা হয় এটি পাকবাহিনি গুলি তখন পাকবাহিনি সারেণ্ডারের জন্য বিভিন্ন স্থানে জড়ো হচ্ছিল, কিন্তু সারেণ্ডার করে ঢাকার পরেঅবশ্যই পাকবাহিনি দ্বারা এই গুলি ছোঁড়ার কথা এরপর তারা সড়ক পথে কুমিল্লা যান, সেখানে সার্কিট হাউসে ভারতীয় বিভিন্ন স্তরের অফিসারদের দেখতে পান তিনি অবাক হয়ে নাকি প্রশ্ন করেন, তোমরা এখানে কেন?  ভারত গন্ধ পান এখানে অথচ, তখন স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সে সময় মিত্রশক্তি হিসাবে সেখানে ভারতীয় বাহিনি বা অফিসাররা থাকার কথা কথাগুলো তিনি জেনারেল ওসমানী বা শেখ কামাল জীবিত থাকতে বলেননি তাঁর মারা যাওয়ার পর এগুলো বলেন কি উদ্দেশে?

ঘটনা সবে শুরু তিনি উচ্চস্বরে বলেন, বঙ্গবন্ধু তারগণস্বাস্থ্য কেন্দ্রএর নাম এবং ভূমিদাতা শুধু ভূমি নয়, আজকে গণস্বাস্থ্যের স্বপ্ন রূপায়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মূল প্রেরণাদাতা উজ্জীবক কিন্তু এই গণস্বাস্থ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী চাকরি দিয়েছেন সিরাজ সিকদারের স্ত্রীকে, আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন সিরাজ সিকদারকে। তাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরাঘুরি করেছেন অথচ, সিরাজ সিকদার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করে যুদ্ধ করছিল দেশকে বিপন্ন করে তুলছিল ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু সিরাজ সিকদার কোনোভাবে বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি তাকে আশ্রয়প্রশ্রয় দেয়া জাতির বুকে ছুরি মারার সমান, বিশ্বাসঘাতকতা। এসব কথা ডা. জাফরুল্লাহ বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বলেছেন তিনি নিয়ে গর্ববোধ করেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তিনি কোনো ভূমিকা রাখেননি, কথা বলেননি বরং জেনারেল জিয়ার উপদেষ্টা হয়েছিলেন জিয়ার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন তিনি

ধীরে ধীরে তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করেন। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে তিনি যুদ্ধাপরাধী কাদেরমোল্লা দেলওয়ার হোসেইন সাঈদীর পক্ষে কথা বলেন তাদের নির্দোষ দাবী করেন আাদালত নিয়ে কটাক্ষ করেন সে জন্য আদালত তাকে কাঠগড়ায়একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা শাস্তি প্রদান করেন তিনি সে শাস্তি ভোগ করেন

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তিনি নিজেকে দেখান দল নিরেপেক্ষ ব্যক্তি। কিন্তু সব প্রতিক্রিয়াশীল লোক স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে দহরম মরহম উঠাবসা নিত্যকার তিনি জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ দানের পক্ষে কথা বলেন জামায়াতে ইসলামী দল হিসবে যুদ্ধাপরাধী রাজনীতি করার যোগ্যতা তারা যুদ্ধাপরাধ করে হারিয়েছে এছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ দিতে হলে আমাদের সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধানে রয়েছেজণগণ ক্ষমতার উৎস তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংবিধান সাংঘর্ষিকএই জন্য তারা নির্বাচন কমিশনে নিবন্দিত হতে পারেনি সুতরাং জাফরুল্লাহ চৌধুরী জামায়তপ্রীতি টা কোন জায়গায় দাঁড়ায়, এটাই প্রশ্ন ইতিহাসের এছাড়া তার নিরপেক্ষতার নমুনা হিসাবে তিনি কখনো শেখ হাসিনার কখনো বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচেনা করেন এটাই তাঁর মুখরোচক অবস্থান

শেষ কথা, নিসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে দেশে গমুখী স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ শিল্প বিকাশে অনন্য ভূমিকার জন্য জাতি তাঁকে মনে রাখবে। কিন্তু সিরাজ সিকদারের রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে সংশ্লিষ্টতা, দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধ্বাপরাধীদের পক্ষালম্বন ও জামায়া, এবি পার্টি প্রভৃতি স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের এডভোকেটের ভূমিকার কারণে সঙ্গতভাবেই তার দেশপ্রেম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠে।নানা সময় তাঁর নানান দৌঁড়ঝাঁপ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেএতে মনে হয়েছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার জন্য যারা এস্টাবলিশমেন্টের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে তিনিও তাই করেছেন

শেষ কথার পেছনের কথা হলগণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’, ‘গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালএবংগণবিশ্ববিদ্যালয়’  কোনোটাই তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নয় বা তিনি মালিক নন এটা একটি এনজিও বা চ্যারিটি সংস্থা, দেশী বিদেশী তহবিল দ্বারা পরিচালিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্যতম ট্রাস্টি ছিলেন তিনি সুষ্ঠুভাবে এবং সৎভাবে পরিচালনার নেতৃত্ব দিয়েছেন, এজন্য অবশ্যই তিনি মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি এছাড়া সবচেয়ে বড় অবদান বা যুগান্তকারি কাজ বলে তাঁর নামে চালানো হয় দেশের ওষধনীতিস্বাস্থনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নতিনি এর প্রণোদনায় অন্যতম ভূমিকা রাখেন বটে, কিন্তুযুগান্তকারি কাজটি করেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞজাফরুল্লাহ চৌধুরী এর অন্যতম সদস্য ছিলেন

যাহোক, তাঁর অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেইসেই ভালোবাসাই প্রয়াণের পর পেয়েছেন তিনিনক্ষত্র হওয়া এবং তাঁর বিপরীত অবস্থান সকলের জানা থাকলেও, এই নিবন্ধ লিখে বলতে হল তাকে নিয়ে বেশি হৈচৈ করার অস্থিরতা দেখে

হামিদ মোহাম্মদ: লেখক ও সাংবাদিক। সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট।

You might also like