ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের বার্ষিক পিকনিক অনুষ্ঠিত
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী
লন্ডন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেছিল লন্ডনের রেড ব্রিজ স্টেশনের কার পার্ক। ৯ জুলাই রোববার সকাল ৯ টার মধ্যে লন্ডনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউ কের সদস্যরা সমবেত হয়েছিলেন সামারট্রিপে বা বার্ষিক পিকনিকে যোগদানের জন্য।
কোচভর্তি শিক্ষার্থীদের নিয়ে চালক ছুটলো ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের নিকটবর্তি অন্যতম আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত ইস্টবোর্ন সী ফ্রন্টের দিকে। প্রায় দুই ঘণ্টা একনাগাড়ে ড্রাইভ করে চালক পৌঁছলেন লন্ডন থেকে ৮৩ মাইল দূরে অবস্থিত ইস্টবোর্ন সমুদ্র সৈকতে।
ইস্ট সাসেক্সের ইস্টবোর্ন ইংলিশ চ্যানেলের উপকূলে অবস্থিত। এই পাথুরে সমুদ্র সৈকতটি প্রায় তিন মাইল দীর্ঘ। এই সমুদ্র সৈকতকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ছিমছাম ইস্টবোর্ন পর্যটক শহর। ইস্টবোর্ন যদিও একটি নতুন শহর, পাথর যুগ থেকেই এখানে মানুষের বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এই জমির আদি মালিক ছিলেন উইলিয়াম কেভেন্ডিস যিনি পরবর্তীকালে ডিউক অফ ডেভনশিয়ার হয়েছিলেন। তারই কল্যাণে এই মনোরম পর্যটক শহর গড়ে উঠেছিল।
ইস্টবোর্ন পৌঁছেই সাবেক শিক্ষার্থীরা ইংলিশ চ্যানেলের স্বচ্ছ নীল পানির মনোরম পরিবেশে আনন্দে মেতে উঠেন।
প্রায় দু মাসের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃষ্টির বাধা ডিঙ্গিয়ে আনন্দ সৌহার্দের ডালি সাজিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যলামনাই ইন দ্যা ইউকের বার্ষিক পিকনিক।
আবহাওয়ার পূর্বাবাসে ছিল ৯ জুলাই রোববার বৃষ্টি হবে। কিন্তু আবহাওয়া ছিল অনুকূলে, বৃষ্টি হয়নি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর মনোরম পরিবেশ এবং রৌদ্রজ্জ্বল দিন পেয়ে দু একজন গেয়ে উঠলেন ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি‘। তাইতো মোরা আজ সব দিগ্বিদিক ছুটি।
পিকনিক শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ pique- nique থেকে। পিকনিকের একটি দিবসও আছে। প্রতিবছর ১৮জুন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটা করে উদযাপিত হয়ে থাকে ‘পিকনিক দিবস‘। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যলামনাই ইন দ্যা ইউকের বার্ষিক পিকনিককে প্রাণবন্ত করার জন্য বাসিত চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে ছিলেন নিলুফা হাসান, মিজানূর রহমান, এরিনা সিদ্দিকী, এম কিউ হাসান, সৈয়দ জাফর, মেহেরুন মালা, রীপা রাকীব, সারমীন চৌধূরী ও বেলাল রশীদ চৌধুরী। প্রস্তুতি পর্বে পিকনিক কমিটিকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেছেন সংগঠনের সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতান, সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র সহসভাপতি প্রশান্ত পুরকায়স্ত বিইএম। সৈয়দ জাফর পিকনিকের জন্য আকর্ষণীয় একটি ফ্লায়ার তৈরী করেছিলেন। কমিটির অক্লান্ত পরিশ্রমে আনন্দঘন পরিবেশে চমৎকার একটি উপভোগ্য পিকনিক অনুষ্ঠিত হলো।
৯ জুলাই সকাল ৯টায় পিকআপ পয়েন্ট ছিল রেডব্রিজ ষ্টেশন। সেখানে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে কোচ প্রস্তুত থাকবে বলে পিকনিক কমিটির পক্ষ থেকে সকলকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। পিকনিকের আয়োজনকে নিখুঁত করার তাড়ণায় আগের থেকেই কমিটির পক্ষ থেকে পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের সকলকে প্রয়োজনীয় আনুষাংগিক জিনিষপত্র যেমন সান লোশন, বসার জন্য চেয়ার, ছাতা, সাঁতারের পোষাক আনার পরামর্শ দিয়েছিল।
সকাল ৯টার আগেই প্রায় সকলে নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির হয়েছিলেন। তবে সব কিছুতো ঘড়ির কাঁটায় চলেনা। পিকনিকের জন্য রওয়ানা দিয়ে বন্যা আহমেদের ‘পথে হলো দেরী‘। তাই চললো অপেক্ষার পালা। অবশেষে দূর থেকে দেখা গেল গোলাপী ড্রেস পরা একজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন। অবশেষে বন্যা এসে পৌঁছুলেন। শুধু বন্যা নন, প্রায় সকলের পরনেইে ছিল রঙীন কাপড়। সাঈদা চৌধুরীকে দেখতে মনে হয়েছিল রঙীন ‘প্রজাপতি‘।
পিকনিক কমিটির আহ্বায়ক বাসিত চৌধুরী লিস্ট ধরে সকলের উপস্থিতি নিশ্চিত করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। শুরুতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রশান্ত পুরকায়স্ত এবং সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সকলকে শুভ কামনা জানিয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। যাত্রার প্রাক্কালে গাড়ীতেই প্রাতঃরাশ খাওয়া হলো। প্রাতঃরাশের পর সৈয়দ জাফরের আনা ফ্লাক্স ভর্তি গরম চা অনেকের ভাগ্যে জুটেছিল।
ততক্ষণে বাসের মাইক চলে গেলো তড়িৎকর্মা এরিনা সিদ্দিকীর হাতে। এরিনা বিভিন্ন জনকে তাৎক্ষণিক মজার প্রশ্নে জর্জরিত করলেন। তবে, কাউকে প্রশ্নে আটকাতে পারেননি। তারপর এম কিউ হাসান, সৈয়দ জাফর ও মিজানূর রহমানের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় শুরু হলো আগত আ্যলামনাই সদস্য, তাদের পরিবার, বন্ধু, অতিথী সকলের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ। শুরু হলো গান, আবৃত্তি, অভিনয়, ছড়া, কৌতুক, ধাঁধাঁ ও স্মৃতিচারণ। বিশিষ্ট গায়ক আ্যলামনাই সদস্য সৈয়দ জুবায়েরের গান সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল। বিখ্যাত গান “চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/ যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…‘ গানের মাধ্যমে শুরু হয় যাত্রা পথে কোচের আনন্দ পর্ব।
একক গান গাওয়ার সুযোগ কমই পাওয়া গেছে, একজন গান ধরলে সকলেই কন্ঠ মিলিয়েছেন। কেউ কাউকে নাহি ছাড়ে সমানে সমান, সমান তালে চলে গান, আবৃত্তি, কৌতুক। এস বি ফারুক, মারুফ চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন, প্রশান্ত পুরকায়স্ত, নিলুফা হাসান, মেজবাহ উদ্দিন ইকো, সৈয়দ এনাম, সৈয়দ ইকবাল, মোস্তাফিজুর রহমান, রাজিয়া বেগম, জাকির হোসেন, কামরুল হাসান, মির্জা আসাব বেগ, ফয়জুর হক রিপন, মতিন চৌধূরী, আবুল কালাম, ড. কামরুল হাসান, মাহফুজা রহমান, বন্যা আহমেদ, সিরাজুল বাসিত, ফখরুল ইসলাম মেজবাহ, তাহমিনা নাহার, এমদাদ তালুকদার এমবিই, সাঈদা চৌধুরী, তামান্না ইকবাল, মাহবুব তালুকদার, রিভা, সুরিতা রাজ্জাকসহ প্রায় সকলে এতে অংশ গ্রহণ করেন। যারা সঞ্চালনায় ছিলেন তারাও সঞ্চালনার পাশাপাশি গান পরিবেশন ও আবৃত্তি করেছেন।
কোচ এসে থামলো আকাংখিত সমুদ্র সৈকতে। চমৎকার আবহাওয়ায় সমুদ্রের নীল নোনা জলে অবগাহনের জন্য সকলে অস্থির হয়ে পরেন। পূর্ব লন্ডনের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট থেকে ব্যারিষ্টার মিজানূর রহমানের তত্ত্বাবধানে ভোরে রান্না করে নিয়ে আসা কাচ্চি বিরিয়ানী, স্বামী কাবাব, মুরগীর রোস্ট ও অন্যান্য খাবার গরম গরম খাওয়ার তাগিদ দিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মারুফ চৌধুরী। একদিকে চলছিল খাবার পরিবেশনের প্রস্তুতি, অন্যদিকে সবুজ ঘাসের প্রান্তরে সঙ্গে আনা বিছানা চাদর পেতে, চেয়ার সাজিয়ে অনেকে বসে পরলেন। ছবি তোলা, ভিডিও করা, ফেসবুকে লাইভ করা নিয়ে অন্য দল মেতে রইলেন। ক্যামেরায় সকলকে বন্দি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সুফিয়ান।
মজাদার খাবার সকলে তৃপ্তি করে খেয়েছেন।
জুলাই মাসে তিন জন আ্যলামনাইর জন্মদিন। ভোজন পর্ব শেষে সকলে মিলে কেক কেটে ‘হ্যাপী বার্থডে‘ গান গেয়ে মারুফ চৌধুরী, এমকিউ হাসান ও এরিনা সিদ্দিকীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
কেক কাটা শেষে নিলুফা হাসান, সৈয়দ জাফর ও এরিনা সিদ্দিকীর আয়োজনে শুরু হয় খেলাধুলা পর্ব। এতে সকল বয়সী সবাই অংশ গ্রহণ করেন। মেয়েদের পিলো পাসিং দিয়ে খেলা শুরু হয়। একে একে সবাই আউট হয়ে যাবার পর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরষ্কারের জন্য লড়াইর মাঠে থাকেন রাজিয়া বেগম, তাঁর মেয়ে রিভা ও নাতনী সাবা। পরবর্তীতে নানী ও নাতনীর মধ্যে বালিশ যুদ্ধে নানীকে হারিয়ে নাতনী সাবা জয়ী হয়।
পুরুষদের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার‘ খেলা পরিচালনা করা ছিল খুবই কঠিন। কেউই চেয়ারের দখল ছাড়তে নারাজ। অবশেষে চেয়ার দখলে প্রথম হয়েছেন সৈয়দ জুবায়ের, দ্বিতীয় হয়েছেন ইসমাইল হোসেন।
শিশুদের চকলেট দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছে তাসফিন তাজ সাঈদা, সোহা রাজ্জাক, তাহুর মনোয়ার সাইদ, সাবা, তাইসির সাইদ। প্রতিযোগী সকল শিশুকে পুরষ্কৃত করা হয়েছে।
চামচের মধ্যে আলু নিয়ে মহিলাদের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন সুরিতা রাজ্জাক। প্রথম স্থান অধিকার করার পর সুরিতা বলেন, আমি রংপুরের মেয়ে, আমাদের এলাকায় আলুর চাষ বেশী হয়, তাইতো আমি প্রথম হলাম। দ্বিতীয় হয়েছেন তামান্না নাহার শিল্পী।
‘নক দ্যা পিনস‘ খেলায় প্রথম হয়েছেন মাহবুব তালুকদার, দ্বিতীয় স্থান দখল করেছেন ফয়জুল হক রিপন।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সাঁতার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা পরষ্পর পরষ্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেও প্রথম স্থান অর্জন করেন সৈয়দ জাফর, দ্বিতীয় সাঁতারু হলেন ব্যারিষ্টার জাকির হুসাইন।
বিভিন্ন খেলার বিজয়ীদের পুরষ্কার স্পন্সর করেছেন সৈয়দ এনাম, মাহফুজা রহমান, মুস্তাফিজুর রহমান, সৈয়দ জাফর, নিলুফা হাসান ও এরিনা সিদ্দিকী।
খাবারের স্পন্সর করেছেন ব্যারিষ্টার আবুল কালাম, ব্যারিষ্টার এম কিউ হাসান, ব্যারিষ্টার মিজানূর রহমান, প্রশান্ত পুরকায়স্ত, বাসিত চৌধুরী ও ইসমাইল হোসেন।
সমুদ্রের নোনাজলে গা ভিজিয়ে সৈকতে আড্ডা দিয়ে কেউ আর বাড়ী ফেরার তাগিদ অনুভব করছিলেননা। তারপরও পরদিন ছুটতে হবে কাজে, তাই নীল জল পেছনে ফেলে লন্ডন ফেরার যাত্রা শুরু হলো। ফেরার পথে ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনেকে ভেবেছিলেন কোচে ঘুমাবেন, কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি। কোচে আবার শুরু হলো সাংস্কৃতিক পর্ব। সৈয়দ জাফরের গাওয়া জারি গান সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তারপর শুরু হলো দু‘দলের গানের প্রতিযোগিতা ‘আনতাকসারি‘। ছেলেরা ও মেয়েরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে চলে এই প্রতিযোগিতা। দু‘দলই নিজেদেরকে জয়ী বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে, এই পর্বে প্রশংসার বাণীই উচ্চারিত হয়েছে বেশী। সকলে এক বাক্যে পিকনিকের সার্বিক আয়োজনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সকলের বক্তব্যে একটি জায়গায় মিল ছিল তা হলো আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা। সংগঠনের উপদেষ্টা শাহগীর বখত ফারুক শোনালেন মধুর বচন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে এসে খুবই ক্লান্ত ছিলাম, আসার ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু নীলু ভাবী (নিলুফা হাসান) আর সুপ্রভা এতো চমৎকারভাবে অনুরোধ করেছে যে আমার কেন, কারো পক্ষেই না বলা সম্ভব হতোনা। তবে, না আসলে সুন্দর এই আয়োজন মিস করতাম।
রাজিয়া বেগম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি শিক্ষক। আমাকে আজকের এই পিকনিক সমপর্কে মার্ক দিতে বললে, আমি দিব একশতে একশ। মারুফ চৌধুরী আগামী বছর সম্বভ হলে ‘বিশ্ব পিকনিক দিবসেই‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের পক্ষ থেকে বার্ষিক পিকনিকে Agadir of Morocco যাবার জন্য পিকনিক কমিটিকে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করার আহবান জানান।
যাত্রা শেষে সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বার্ষিক পিকনিক কমিটিকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রশান্ত পুরকায়স্ত আয়োজনকে সাফল্যমন্ডিত করতে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আজকে যে সুন্দর দিন কাটালাম তা স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে।