ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর: পরাধীন দেশে ভর্তি হয়ে স্বাধীন দেশে ডিগ্রী লাভ

 আবু মুসা হাসান 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হলো ১ জুলাই বৃহস্পতিবার। হিসেব করে দেখলাম এই একশো বছরের মধ্যে আমি ফুল টাইম ছাত্র হিসেবে কাটিয়েছি সাত বছর। অর্থাৎ শতকরা সাত ভাগ সময়ের জন্য আমি এই বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। মাস্টার অফ সোশাল সায়েন্স (এম এস এস) পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে টিএসসি‘র সুইমিং পুলের পাশে আমাদের বিদায় সংবর্ধনায় কে এম সাদউদ্দিন স্যার বলেছিলেন, ‘‘অনার্স ও এমএ পাশ করতে চার বছরের স্থলে প্রায় সাত বছর লেগে গেলেও তোমরা আসলেই সৌভাগ্যবান। পরাধীন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একটি স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বের হচ্ছো।‘‘ আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সাত বছরই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।

ঢাকা কলেজের কমার্স বিভাগ থেকে এইচ এস সি পাস করার পর ১৯৭০-৭১ শিক্ষা বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এখনকার প্রজন্মের পাঠক হয়তো ভাববেন যে, আমি হয়তো কমার্স অনুষদের বদলে ভুল করে কমার্স বিভাগ লিখেছি। না পাঠক, আমি ভুল করিনি। আমাদের সময় বিষয়ভিত্তিক বিভাগ ছিলনা, ছিল শুধু বিকম অনার্স।
তবে ভর্তি হয়ে বেশীদিন ক্লাশ করার সুযোগ পাইনি। ‘৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর কাপুরুষিত আক্রমণ করার পর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য ঢাকা ছেড়ে চলে যাই। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতে হবে, পড়াশুনা করতে হবে তা কখনও ভাবিনি। কারন আমরা ভিয়েৎনামের মতো দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।

তাই, স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে আসলেই বিপদে পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছেন। অন্যদিকে, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলাম, তাদেরকে অটো প্রমোশন দেয়া হলো। দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস শুরু করার পর কমার্সের ডেবিট-ক্রেডিট, ব্যালান্স সীট ইত্যাদি কিছুই মাথায় ঢুকছিলনা। এমন সময় হঠাৎ এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলাম যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যেহেতু তিন মাস ক্লাস হয়নি, তাই বিধি অনুযায়ী আমাদের ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ করার সুযোগ আছে । ঐ কথা শুনেই এক দৌড়ে কলাভবনের নিচ তলায় ডীন অফিসে গেলাম । অফিস সহকারী বজলুর রহমান আমার পূর্ব পরিচিত। নতুন পল্টন লাইনের বাসিন্দা, পাড়ার বড় ভাই। বজলু ভাইকে বল্লাম, আমি ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ করবো, কিভাবে করতে হবে? তিনি জানালেন যে, আজ লাস্ট ডেট, এতোদিন কোথায় ছিলে? তোমার পক্ষে দুই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সই যোগাড় করা সম্ভব হবেনা। আমি তাকে বল্লাম যে, ফর্ম দিন। আমি দুই চেয়ারম্যান স্যারের সই না নিয়ে আসা পর্যন্ত আপনি ফর্মগুলো রেজিষ্ট্রার অফিসে জমা দিবেননা, তাহলেইতো হলো। বজলু ভাই রাজি হলেন। তরিঘড়ি ফর্মটি পূরণ করে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল করিম স্যারের কাছে যেতেই তিনি বিনা বাক্যে সই দিয়ে দিলেন। কিন্তু কমার্স বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর আব্দুল্লাহ ফারুকের কাছ থেকে নো অবজেকশন বা অনাপত্তি নিতে গিয়ে মহা বিপাকে পড়লাম। তিনি কিছুতেই ছাড়পত্র দিবেননা। বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কমার্স ছেড়ে কেউ কি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যায়? তবে আমি নাছোড়বান্দা, অনেক চেষ্টা করে স্যারের সই নিয়ে ফর্মটি বজলু ভাইকে দিয়ে এলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হয়ে ডেভিড-ক্রেডিট এর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম।

টি এস সি মিলনায়তনে মহসিন হলের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে হল সংসদের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা হাসান বক্তব্য রাখছেন । ডান দিক থেকে মঞ্চে উপবিষ্ট রয়েছেন উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী, হল প্রভোস্ট ওদুদুর রহমান খান এবং ভারপ্রাপ্ত ভিপি নুরুল ইসলাম।

এদিকে, মা-বাবার অনুশাসনের বাইরে এসে মুক্তভাবে ছাত্র রাজনীতি করার জন্য আমি হলে চলে এলাম। ক্যাম্পাস থেকে মাত্র ১৫/২০ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ দূরে নতুন পল্টন লাইনে ছিল আমাদের বাসা। হাজী মুহাম্মাদ মহসিন হলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ৬৬০ নম্বর সিঙ্গেল রুমে এসে উঠলাম। আবাসিক ছাত্র হলেও সেলিম ভাই থাকতেন নয়াপল্টনে নিজেদের বাড়ীতে। পরবর্তীতে আমার নামে বরাদ্ধকৃত ২৪২ নাম্বার রুমে চলে আসি। ‘৭২ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনে আমি মহসিন হল ছাত্র সংসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হই। ঐ সময়ের অন্যতম মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ আব্দুর রকীব (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই ইউ কে এর সাধারণ সম্পাদক) নির্বাচিত হয়েছিলেন হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক। করোনার ছোবলে প্রয়াত বিশিষ্ঠ নাট্য অভিনেতা আব্দুল কাদের ছিলেন আমাদের সংসদের নাট্য সম্পাদক।

মহসিন হালের শহীদ মিনার
সাদউদ্দিন স্যারের বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলতে হয়, আসলেই আমরা ছিলাম সৌভাগ্যবান এবং অনেক কর্মকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। স্মৃতি বিজরিত ঐসব কর্মকান্ডের কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে মহসিন হলে শহীদ মিনার নির্মানের কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। আর তাদের তাবেদার ও দোসররা সারা দেশের শহীদ মিনারগুলো ভেঙ্গে ফেলেছিল। তাই স্বাধীনতার পর নির্বাচিত প্রথম ছাত্র সংসদ হিসেবে হলের শহীদ মিনার পুনঃনির্মানের দায়িত্ব বর্তায় আমাদের ওপর। হল কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনার নির্মান করার জন্য ছাত্র সংসদকে মাত্র এক হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। আমরা সংসদ থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তৎকালীন ডিজাইনার শিল্পী আনোয়ার হোসেনকে শহীদ মিনারটি নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। শিল্পী আনোয়ার হোসেনসহ একদল প্রগতিশীল শিল্পী স্বাধীনতার পর ঢাকা শহরের রাজপথের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মায়ের কোলে শহীদের লাশ সদৃশ অস্থায়ী মোড়্যাল তেরী করেছিলেন। ঐগুলোর নীচে লেখা ছিল, ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, এসো এবার দেশ গড়ি’। আনোয়ার ভাই কংক্রিটের একটি উঁচু অর্ধবৃত্ত প্লাটফর্মের ওপর ঐ মোড়্যালটির আদলে শহীদ মিনার নির্মানের পরিকল্পনা নিলেন। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ সবগুলো ছাত্র সংগঠন এই পরিকল্পনায় বাদ সাদলো। আসলে আমাদের সংসদকে ব্যর্থ সংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্যই প্রতিপক্ষ ছাত্র-সংগঠনগুলো নানা ফন্দি-ফিকির করে শহীদ মিনার নির্মানে বাধা দিতে লাগলো। এমনকি ‘মূর্তি’ বানানো যাবেনা বলেও দাবি তুললো। এ নিয়ে হলে চরম উত্তেজনা শুরু হলে প্রভোষ্ট প্রফেসর ওদুদুর রহমান খান স্যার তার অফিসে সর্বদলীয় বৈঠক আহবান করলেন। অন্যদিকে ‘৭৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আগে শহীদ মিনারের নির্মান কাজ শেষ করার জন্য আমরা কৌশুলী হলাম। শিল্পী আনোয়ার হোসেনের প্রস্তাব অনুযায়ী প্লাটফর্মের ওপরে টাইলস এর মাধ্যমে লাল গোলাপের মধ্যে একটি পাখী বানানোর প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

ইট-পাথর- বালু-সিমেন্ট নিয়ে শহীদ মিনার বানাও
এরপর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শহীদ মিনারের নির্মান সম্পন্ন করার জন্য আমরা ক্ষিপ্র গতিতে কাজ শুরু করলাম। কিন্তু এক হাজার টাকা দিয়ে এতো বড় স্ট্রাকচার বানানো অসম্ভব ব্যাপার ছিল। ওদুদুর রহমান স্যারের সাথে দেন-দরবার করে আরও পাঁচশ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেল। কিন্তু তাতেও কোন কূল-কিনারা হলোনা। নিরুপায় হয়ে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এম এ সামাদের নেতৃত্বে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী দবির উদ্দিন আহমেদের কাছে সাহায্যের জন্য গেলাম। তিনি ছিলেন তখনকার দেশ সেরা এ্যাথলেট সুলতানা আহমেদ খুকীর বাবা। পরবর্তীকালে শেখ কামালের সাথে সুলতানা আহমেদ খুকীর বিয়ে হয়েছিল। কামাল ভাই এবং খুকী আপা সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আমাদের এক ব্যাচ ওপরে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে দেশসেরা এ্যাথলেট সুলতানা কামালও ঘাতকদের বুলেট থেকে রেহাই পাননি।
প্রধান প্রকৌশলী দবিরউদ্দিন আহমেদ আমাদের অসহায়ত্ব দেখে ধমকের সুরে বল্লেন, তোমরা কি ধরনের ছাত্র রাজনীতি কর? পাকিস্তানীরা শহীদ মিনার ভেংগে ফেলেছে। স্বাধীন দেশে শহীদ মিনার বানাবে, এর জন্য এতো দুশ্চিন্তা করতে হয় নাকি? ইউনিভার্সিটির যেখানে যা পাবে, ইট-পাথর-বালু-সিমেন্ট- সব নিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে ফেলো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের কাছে ৫০ বস্তা সিমেন্ট ধার চেয়ে উপচার্যের বরাবরে ছাত্র সংসদ থেকে একটি দরখাস্ত লিখে আমার কাছে নিয়ে এসো। দরখাস্ত নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আমাদের ৫০ বস্তা সিমেন্ট ‘ধার‘ দিয়ে দিলেন। আমাদের হলের ছাত্রকর্মীরা প্রকৌশল বিভাগের ঠেলাগাড়ী দিয়ে সিমেন্টের বস্তাগুলো হলে নিয়ে আসলো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিয়মান নিপা ভবনের ঠিকাদার, জগন্নাথ হলের উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত ঠিকাদার এবং এমন কি নির্মিয়মান জাতীয় সংসদ ভবন এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ঠিকাদারের কাছ থেকেও সিমেন্ট চেয়ে এনেছি। আমাদের এই বিশাল উৎসাহী কর্মীবাহিনীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমাদের যুক্তরাজ্যের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাই মো: শরফ উদ্দিন।

স্বাধীনতার পর মহসিন হল ছাত্র সংসদের উদ্যোগে নির্মিত শহীদ মিনার।

ছাত্র ব্রিগেড ও দেশ গড়ার আন্দোলন
যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য ডাকসুর পক্ষ থেকে শুরু হয়েছিল দেশ গড়ার আন্দোলন। ছাত্র ব্রিগেডের সদস্য হয়ে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করতে এবং শ্রমিক এলাকায় নাইট স্কুল চালু করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলাম। ছাত্র ব্রিগেডগুলোর অধিকাংশ সদস্যই ছিলাম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ডাকসু থেকে যখন ব্রিগেড গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল তখন আমাদের সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা চালছিল। ব্রিগেড নিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ার নময় ইকোনমিক্স পরীক্ষার তিনটি পেপারের মধ্যে দুটি পেপারের পরীক্ষা হয়েছিল, একটি পেপারের পরীক্ষা বাকি ছিল। ডাকসু থেকে ভিসি এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আমাদেরকে প্রথম দুই পেপারের নাম্বার গড় করে তৃতীয় পেপারের নাম্বার দেয়া হয়েছিল।
ছাত্র ব্রিগেড নিয়ে প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম আদমজী জুট মিলে। কিন্তু ঐসময়ের শ্রমিক অসন্তোষ এবং ক্ষমতাসীন শ্রমিক সংগঠনের চরম উপদলীয় কোন্দল ও হাঙ্গামার ফলে নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুদিন কাজ করার পরই আমাদেরকে আদমজী জুট মিল ছেড়ে আসতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে আমরা ক্যাম্প করেছিলাম ঢাকার নিকটবর্তী কাঞ্চন এলাকার জুট মিলগুলোতে। তবে আদমজী জুট মিলে কাজ করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছিলাম। অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষায় আমাদের একটি মনোগ্রাফ জমা দিতে হতো। মনোগ্রাফের জন্য কতো নাম্বার ছিল মনে নেই। সরেজমীন অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ‘লেবার আনরেস্ট ইন আদমজী জুট মিল‘ শীর্ষক মনোগ্রাফ জমা দিয়েছিলাম। গতানুগতিকতার বাইরে মনোগ্রাফের বিষয় বেছে নেয়াতে অনার্সের ভাইবা পরীক্ষার দিন বিভাগীয় প্রধান ড. এ কে নাজমুল করিম স্যার আমার খুবই প্রশংসা করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র আদমজী জুট মিলের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়েই প্রশ্ন করলেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বীজতলা
বন্যার সময় দেশব্যাপী কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য ডাকসু থেকে আমারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি টোকেন বীজতলা তৈরি করেছিলাম। বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি পুকুর ছিল। আমরা ঐ পুকুর পাড়ে বীজতলা তৈরী করি । ধানের চারাগুলো একটু বড় হওয়ার পর ডাকসুর সদস্য প্রয়াত শহিদুল ইসলাম বাদলের নেতৃত্বে আমরা একটি পিকআপ ভ্যানে করে চাঁদপুরের মতলবের কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম।

মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গণে আটার রুটি বানানোর ফ্যাক্টরি
১৯৭৪ নালে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় আমরা ডাকসু এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দূর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাই। দেশব্যাপী এই উদ্যোগে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও এগিয়ে এসেছিল। ডাকসু থেকে মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গনে আটার রুটি বানানোর ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। শত শত ছাত্র-ছাত্রী দলবেঁধে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রুটি বানিয়েছে এবং লোহার পাতের বড় তাওয়ায় ছেঁকেছে। প্রতিদিন বিকেলে বিমানবাহিনীর সদস্যরা এসে রুটিগুলো নিয়ে যেতেন এবং হেলিকপ্টার দিয়ে দূর্গত এলাকার মানুষদের মধ্যে বিতরণ করতেন। সন্ধ্যায় আমার দায়িত্ব ছিল ডিসির বাসভবনে গিয়ে কোঅর্ডিনেশন কমিটির মিটিংয়ে গিয়ে ডাকসুর কার্যক্রম নিয়ে রিপোর্ট করা। ঐ সময় ঢাকার ডিসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ। পরবর্তীকালে তিনি স্বরাষ্ট্র এবং যোগাযোগ সচিব এর দায়িত্ব পালন করেছেন ।

ডাকসু সপ্তাহ
১৯৭৪ সালে ডাকসুর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপিত হয়েছিল। ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপন পরিষদের আহবায়ক। হামিদ ভাইও ছিলেন মহসীন হলের আবাসিক ছাত্র। আমার উপর ছিল হামিদ ভাইয়ের অগাধ আস্থা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপন কমিটির ক্রীড়া উপ-পরিষদের আহবায়ক করেছিলেন আমাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উপলক্ষে আমরা সব ধরনের ইনডোর গেইমস প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। তবে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে গিয়ে মহা বিপাকে পড়েছিলাম। টিএসসির সুইমিংপুলে সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা সুইমিংপুলে পানি সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন এই বলে যে, পানি দিয়ে সুইমিং পুল ভরতে গেলে রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে তীব্র পানির সংকট দেখা দিবে। এই অবস্থায় ফায়ার ব্রিগেডের শরনাপন্ন হলাম জগন্নাথ হলের পুকুর থেকে পানি আনার জন্য। কিন্তু তাও হলোনা, জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তাদের পুকুর থেকে পানি আনলে পুকুরের মাছ মরে যাবে। এই অবস্থায় আমরা গভীর রাতে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুর (বাংলা একাডেমীর উল্টো দিকে) থেকে পানি এনে টিএসসি‘র সুইমিং পুলকে সাঁতারের উপযোগি করে তুললাম। পরদিন আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলার বোস প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী সাঁতার প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করলেন।

আমার নির্বাচনে ছাত্র লীগের ভিপি ক্যান্ডিডেট চাঁদা দিলেন
আমাদের সময় ছাত্র রাজনীতিতে বিভাজন থাকলেও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করলেও মুজিববাদী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এর নেতা-কর্মীদের সাথে আমার চমৎকার সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা তুলে ধরছি।
আমি হল সংসদের এ জি এস পদে মনোনয়ন পেয়েছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন এর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রার্থীদের উপর চাঁদা ধার্য্য করা হয়েছিল। আমাকে বলা হলো ৮৫ টাকা চাঁদা দিতে হবে, জি এস এবং ভিপি প্রার্থীদের দিতে হবে যথাক্রমে ১২৫ টাকা এবং ১৫০ টাকা। শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। ১৯৭২ সালে ৮৫ টাকা জোগাড় করা দূরহ কাজ ছিল। অনেক চেষ্টা করে ৬৫ টাকা জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মন খারাপ করে সকালে হল ক্যান্টিনের এক কোনায় বসেছিলাম। এমন সময় মুজিববাদী ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমদ কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে হাসান, মন খারাপ কেন? বল্লাম, নির্বাচনের জন্য আজ চাঁদা দেয়ার শেষ দিন। ৮৫ টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সরফু ভাই বল্লেন, কত টাকা জোগাড় হয়েছে? জানালাম, ৬৫ টাকা জোগাড় করতে পেরেছি। সরফু ভাই সাথে সাথে পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা আমার চাঁদা। যদিও আমি জানি যে তুই আমাকে ভোট দিবিনা, ভোট দিবি মন্টুকে (ছাত্র ইউনিয়ন এর ভিপি প্রাথী নাজমুল হাসান মন্টু)। নির্বাচনে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের ১২ জনের পূর্নপ্যানেল জয়লাভ করে।
প্রয়াত শরফুদ্দিন ভাই পড়াশোনা শেষ করার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

এজিএস থেকে জিএস এবং রোকেয়া হলের বার্ষিক ডিনার
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আমি মহসিন হল ছাত্র সংসদ এর এজিএস নির্বাচিত হই। পরবর্তী বছরের নির্বাচন বানচাল হয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন কোন নির্বাচন হয়নি। ‘৭৫ সালে সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত আমাদেরকেই সংসদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হয়েছিল। এদিকে, ‘৭৪ সালে জিএস এম এ সামাদ এবং ভিপি নাজমুল হাসান মন্টু তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং কার্যকরি সদস্য নূরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সহ-সভাপতি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল।
হল সংসদের জিএস হওয়ার পরের একটি ঘটনা শেয়ার করার লোভ সম্বরণ করতে পারছিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের প্রতি সব ছেলেদেরই কম-বেশী আকর্ষণ ছিল। ঐ হল দুটির সামনে অনেকেই মেয়ে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিলেও হলগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু মহসিন হলের জিএস এর দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রোকেয়া হল পরিদর্শন করার। মনে পড়ে, হলের ডাইনিং রুমে বার্ষিক ডিনারের অনুষ্ঠানে উপাচার্য ও অন্যান্য হলের ভিপি- জিএসদের সাথে আমাকে পেয়ে সহপাঠি শান্তি ও স্মৃতি মহাখুশী হয়েছিল এবং একটু পর পরই আমার প্লেটে প্রচুর খাবার তুলে দিচ্ছিল।

আবু মুসা হাসান: সাংবাদিক, উপদেষ্টা সম্পাদক, সত্যবাণী।

You might also like