দু’বার হত্যা করা হলো জাতির জনককে : আগষ্ট ১৯৭৫, আগষ্ট ২০২৪
আবু মুসা হাসান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দুইবার হত্যা করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাসবভনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঐসময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
জাতির জনককে কারা হত্যা করেছিল, কেন হত্যা করেছিল এবং কে বা কারা এই হত্যাকান্ড থেকে লাভবান হয়েছিলেন, ঐসব বিষয় নিয়ে আজ কিছুই লিখবনা। আজ শুধুমাত্র জাতির জনকের প্রতি জানাবো বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে ঘাতকের দল যখন হত্যা করেছিল, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্বাধীনতার পর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মুহসিন হল ছাত্র সংসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এ জি এস) নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালে আমি ছিলাম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কর্মসূচি ছিল। অন্যান্য হলের ছাত্র সংসদের ভিপি এবং জিএসদের সাথে মুহসিন হল ছাত্র সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমিও টিএসসি’র ঐ সভায় আমন্ত্রিত ছিলাম। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো।
ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করলেও তাঁর প্রতি অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধা দেখানোর দুঃসাহস দেখায়নি। গুলিতে নিহত বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ সিঁড়িতে পড়ে ছিল। যতটুকু মনে পড়ে দুদিন পরে দাফন করার জন্য তাঁর লাশ হেলিকপ্টার যোগে গোপালগঞ্জের টুংগীপাড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
‘৮০র দশকের শুরুতে দলীয় রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে আমি দৈনিক সংবাদ এর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু করি। ঐ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বাকশাল নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
সম্ভবত ১৯৮৪ সালের ১৫ই আগস্ট আমাকে তৎকালীন বাকশাল নেতা আব্দুর রাজ্জাকের সফরসঙ্গী হিসেবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যেতে হয়েছিল। ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাকশাল টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্হলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। বাকশালের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে মরহুম সৈয়দ আহমদ এবং মরহুম শফিকুল আজিজ মুকুল, মরহুম আব্দুর রাজ্জাকের সফরসঙ্গী ছিলেন।
ঐ সময় কবরের পাশেই বারান্দায় দেখতে পেলাম একটি কফিন। এই কফিনে করেই হেলিকপ্টারযোগে বঙ্গবন্ধুর লাশ ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় আনা হয়েছিল। ঐদিনের ঘটনা জানতে চেয়েছিলাম একজন প্রতক্ষদর্শীর কাছে। তার বিবরণ অনুযায়ী হঠাৎ থানা থেকে পুলিশ এসে বাড়ির লোকজনকে জানাল, বঙ্গবন্ধুর লাশ হেলিকপ্টার করে নিয়ে আসা হচ্ছে, দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভদ্রলোক জানালেন, কাপড় ধোয়ার ৫৭০ সাবান দিয়ে লাশ গোসল করিয়ে তড়িঘড়ি করে জানাজা শেষে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আঙিনায় লাশ দাফন করা হয়। (দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারটি বিস্তারিত ভাবে ছাপা হয়েছিল।)
বঙ্গবন্ধুর লাশ ঢাকার পরিবর্তে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছিল এই কারনে যে, রজধানীর পরিবর্তে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রামে কেউ তাঁর খোঁজখবর নেবেনা। তাছাড়া জাতির জনককে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধের মুল শ্লোগান, লাখো মুক্তিযোদ্ধার শক্তি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও নির্বাসিত হলো। আরো কত কি পরিবর্তন হলো। এগুলো লিখে শেষ করা যাবেনা। জাতির জনককে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করলো। ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবটি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেও ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে বঙ্গবন্ধু শব্দটি পরিহার করা হলো। আমার মনে আছে, কেবলমাত্র সংবাদ এবং তৎকালীন বাংলার বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা হতো।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, এতো কিছু করেও তাকে বাংলার মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। কোটি বাঙ্গালীর মনের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রামের সমাধিস্হল মুজিব ভক্তদের তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হলো।
২০২৪ সালের আগষ্টে এবার জাতির জনককে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হলো। বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলার বটগাছ উপড়ে ফেললেও ৩২ নম্বরের এই ঐতিহাসিক বাড়িতে হাত দেয়ার সাহস পায়নি। ‘৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরও খুনিরা এই বাড়ি অক্ষত রেখেছিল। কিন্তু এই বাড়ি এখন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর বাড়িই নয়, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে, সারাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতি সৌধগুলো ধ্বংস করে দিল, মেহেরপুরের আম্রকাননের ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ভাস্কর্যগুলোও ভেঙে চুরমার করে দিল, এগুলো কিসের আলামত? এসব অপকর্মকে গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের সেলিব্রেশন বা উদযাপন বলে চালিয়ে দিলে তা দেশবাসী নীরবে নিশ্চুপে মেনে নেবে তা ভাবার কোন কারন নাই। জাতির জনক বাঙালির মনের মণিকোঠায় বেঁচে থাকবেন, তাঁর ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা, ‘’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ চির অম্লান থাকবে।
আবু মুসা হাসান, উপদেষ্টা সম্পাদক, সত্যবাণী
লন্ডন, ১৫ই আগস্ট’২০২৪
।