নৌ-দূর্ঘটনা পিছু ছাড়ছেনা হাওরবাসীর

শামীমআহমদতালুকদার
সত্যবাণী

সুনামগঞ্জ থেকেঃ সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার হাওরে বিগত ১০ বছরে ২৪ টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭০ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।আর আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। চলতি বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বর্ষা মওসুমে বিশাল হাওর ও নদী পথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যাত্রীরা রয়েছেন চরম শংষ্কায় রয়েছেন।এদিকে হাওর পাড়ের মানুষের যাতাযাতের একমাত্র মাধ্যম নৌ-যান ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে।অন্যদিকে হাওরে ও নদী পথে প্রতিনিয়তই নৌ-দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছেনা হাওরবাসীর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা হাওরে চলতি বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে। জুলাই-আগষ্ট মাসে ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও ছাতক উপজেলায় নৌকা ডুবে প্রায় ৫ জনের প্রাণহানী হয়েছে।এদের মধ্যে ৩ জন তাহিরপুর উপজেলার। এছাড়াও ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলায় হাওরে নৌকা ডুবে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সহ ১৭ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানী ঘটেছে।৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার মধ্যবর্তী গুমাইনদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।নিহতদের মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর থানার ইনাতনগর গ্রামের ৯জন, পাইকুরাটি ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের ২ জন ও নেত্রকোনার মেদনী গ্রামের বাসিন্দা।

সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলায় বর্ষাকালে নদী পথে হাওরে যাতাযাতে ও পণ্য পরিবহনে একমাত্র সহজ ব্যবস্থা হিসেবে চলছে ইঞ্জিন চালিত ষ্টীল বডি নৌকা ও কাঠের তৈরী নৌকা। বর্ষা ছাড়াও সারা বছরে জেলার নদী পথে চলে ইঞ্জিন চালিত ষ্টীলবডি বড় বলগেট নামে নৌকা ও যাত্রীবাহী নৌকা। বেশি লাভের আশায় অতিরিক্ত মালামাল নেয়া, পরিবহনে অদক্ষ চালক, অসাবধানতা, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, জোড়াতালি দিয়ে ত্রুটিযুক্ত ট্রলার চলাচলের কারণে বিগত কয়েক বছরে এই পথেই পৃথক-পৃথক ২৪ টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭০ জনের করুন পরিণতিতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।আহত হয়েছেন অসংখ্য যাত্রী তারমধ্যে শিক্ষার্থী, গরীব অসহায় শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশী।

হাওরের লোকজন জানান, এই ২৪ টি নৌ-দুর্ঘটনার মধ্যে বেশীর ভাগই কোন প্রাকৃতিক কারনে ঘটেনি। নৌ-যান চলাচলের নীতিমালা না মানার কারণে আর অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, জোড়াতালির নৌকা চলাচলের জন্যই বিভিন্ন সময়ে জেলার নদী পথে ও হাওরে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় দৌড়-ঝাঁপ আর উদ্ধার তৎপরতা। অভিযোগ উঠেছে জেলায় ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কোন যন্ত্রপাতি না থাকায় উদ্ধার কাজও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়না। নদী পথে নৌযান চলাচলে আইন মানা হচ্ছে কি-না বিআইডব্লিটির দেখার কথা থাকলেও তাদের কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে জুন মাসে জেলার ধর্মপাশার শৈলচাপড় হাওরে ট্রলার ডুবে শিশু-নারী ও শিক্ষাথী সহ ১৬ জনের প্রানহানী ঘটে। ২০১১ সালে সেপ্টেম্ভর প্রায় শেষের দিকে জামালগঞ্জের দুর্লভপুর গ্রামে অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কারনে ট্রলার ডুবে ৫ শিশুসহ ৮ যাত্রীর প্রাণহানী ঘটে। একই বছর জুন মাসে তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী যাদুকাটা নদীতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারনে এক নির্বাচনী প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ২০ জুলাই সুরমা নদী পাড়াপাড়ের সময় নৌকা ডুবে মারা যান ছাতক উপজেলার এক ইউপি সদস্য। একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্ভর কাঠইর নদীতে বর যাত্রীবাহী নৌকা ডুবে নববধু সহ ২ জনের করুন মৃত্যু হয়। ওই বছরেই ১৮ ডিসেম্ভর জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের ধনু নদীতে কামধরপুর গ্রামের বাঁকে পাথর বাহী বলগেট ও যাত্রীবাহী নৌকার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৪২ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১২ সালে ধর্মপাশা উপজেলার সোনা মড়ল হাওরে ট্রলার ডুবে ৪ জন যাত্রী মারা যান।

একই বছর ১১ জুন সুনামগঞ্জ সদরের উজান রাম নগরের যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে ১ জনের মৃত্যু হয়। ১০ ফেব্রুয়ারী জামালগঞ্জ ও ধরমপাশা উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে ট্রলার ডুবে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারীতে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় লক্ষ্মী বাউর দোহালিয়ায় সুরমা নদীতে অগ্নীকান্ডের ঘটনায় আগুনে পুড়ে শিশুসহ ১২ জন মারা যান। ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত পাঠলাই নদীতে খেয়া পাড়াপাড়ের সময় ১ শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীতে নৌকা ডুবে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই বছরই জুনের মাঝামাঝি তাহিরপুরের পাতারগাাঁও সেতুর পাশে নৌকা ডুবে মা-ছেলে-নানীসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলার মল্লিক পুরে বালু ভর্তি বলগেট নৌকা ডুবে ৩ জন প্রাণ হারান। জুলাই মাসেই শেষের দিকে মধ্যনগর থানার গোমাই নদীতে এক স্কুল শিক্ষক নিহত হয়েছেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর থেকে মোহনপুর আসার পথে রাত ৯টায় বালুভর্তি নৌকার ২ জন ভলগেট নৌকার ধাক্কায় পানিতে ডুবে মারা যান। আগষ্টের শেষে দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউপির বাংলাবাজার সংলগ্নে নৌকা ডুবে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবরের শেষে তাহিরপুরের সীমান্তে পাঠলাই নদীতে নৌকা দিয়ে পাড়াপাড়ের সময় রাতে এক বিজিবি সদস্য নিহত হন। নভেম্বরের প্রথমার্ধে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই

এর কারনে জেএসসি পরীক্ষার্থী সহ প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকা ডুবির কারনে প্রায় ৪০ জনের মতো আহত হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি ভোরে তাহিরপুরের সীমান্ত রাঙ্গাছড়া নদীতে নৌকার সংঘর্ষে ১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের মাজামাঝি দিরাই চাতল বিলে নৌকা ডুব ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ২০১৭-২০১৮ সালে জেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েক জন নৌ-দুর্ঘটনায় মারা গেলেও নিহতদের সংখ্যা নির্ণয়ে সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে দিরাই উপজেলার কারিগুটা হাওরে ট্রলার ডুবিতে ১০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জুলাই-আগষ্ট মাসে ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও ছাতক উপজেলায় নৌকা ডুবে প্রায় ৫ জনের প্রাণহানী হয়েছে। ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলায় হাওরে নৌকা ডুবে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক সহ ১৭ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানী ঘটেছে। ৯ সেপ্টেটম্বর সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার মধ্যবর্তী গুমাইনদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মোহনগঞ্জ উপজেলার হাওর গবেষক কবি রইস মনরম জানান, নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জের হাওর ও নদী পথে ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচল বন্ধ করা যাবে না। তবে নৌ চলাচলে যে নীতিমালা আছে তা নৌ-মালিকরা যদি মেনে চলেন আর শ্রমিকদের উদ্যোগ জনসচেতনতা সৃষ্টি করলে দুর্ঘটনার হার অনেকটা কমে যাবে। তবে বিআইউব্লিউটি কর্তৃপক্ষের তদারকি জোরদার করতে হবে। সকল প্রকার নৌযানে যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট রাখা নিশ্চিত করতে হবে।তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক জানান, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এর কারনে যেসব প্রাণ ঝড়ে গেছে, তাদের যন্ত্রানা নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে দুর্ঘটনা কবলিত পরিবার গুলো। নৌ-পথে গুরুত্বপূর্ন স্থানে মেরিন কোট স্থাপন ও বিআইডব্লিউটির শাখা স্থাপন আর জনসচেতনতা তৈরী করলে দুর্ঘটনা কমে যাবে।জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম জিলানী আফিন্দী রাজু জানান, নৌ-চলাচলে যে সব নীতিমালা রয়েছে তা অমান্য করার কারনেই বিভিন্ন সময়ে এই প্রাণহানী ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারী ও সময়ে সময়ে টহলরত থাকলে নৌ-মালিক ও শ্রমিকরা আরো বেশী সচেতন হবেন।

You might also like