পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সামাজিক আন্দোলন

পারভেজ হাসেম
অতিথি লেখক

এপ্রিল ২৪, ২০২৩, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রয়াণে প্রায় ৮৪ বৎসরের শারীরিক জীবনের অবসান হয়েছে। এই ৮৪ বছর আয়ুষ্কালে শৈশব ও কৌশরের কিছ–টা সময়কাল বাদে পুরোটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন। তিনি অন্যকোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন না কখনই রাজনীতিই তার ধ্যান জ্ঞান ; আমৃত্যু সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই তাঁর প্রয়াণ।পঙ্কজ ভট্টাচার্য তারুণ্যের প্রথম প্রহরে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তখন থেকে প্রায় দুই দশক তিনি নিরলস ও নিবিড়ভাবে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতির বিকাশে কাজ করেছেন।একজন কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।এই ভূখ-ের রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবজ্জ্বল ৬০ এর দশকের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভূত্থানে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় তিন বছরের বেশী সময় আগে স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে তিনি কারাবরণ করেন। এই মামলায় তিনি ছিলেন প্রধান আসামী। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গড়ে তোলাসহ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টিতে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে সে সময়ের অন্যতম বড় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনসহ দেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঐক্য ন্যাপের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।একজন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পঙ্কজ ভট্টাচার্য নির্দিষ্ট নীতিÑআদর্শ ও লক্ষ্য অর্জনে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিলো বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও সবার জন্য বাংলাদেশ গড়ে তোলা, সে পথেই তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন।যাঁরা বিপ্লবের পথে মুক্তির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি করেন, তাঁদের সামাজিক আন্দোলন বিমুখতা ও নিস্পৃহতা পরিলক্ষিত হলেও পঙ্কজ ভট্টাচার্য এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সামাজিক পরিবর্তনের স্পৃহায় তিনি একইসাথে রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের পথে সমান্তরাল হেঁটেছেন, যা সামাজিক আন্দোলনকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। এ জন্য জাতির ক্রান্তিলগ্নে ২০০০ সালে অজয় রায়, পীর হবিবুর রহমান, কাজী আরেফ আহমেদসহ আরও অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তির সমন্বয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য সামাজিক আন্দোলনের অনিবার্যতায় “সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনে সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে তিনি সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সারাদেশে বিশেষ করে দেশের ৩৩টি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বাম, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে টার্গেট করে পরিচালিত সাম্প্রদায়িক সংহিসতা, খুন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য অন্যান্য প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠনের সাথে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা তৎকালীন সংখ্যালঘু, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীলদের নিঃশে^ষকরণের সুপরিকল্পিত নীল নকশাÑপরিকল্পনা ও চক্রান্ত রুখে দিয়েছিল। এই ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে “সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন” ও “সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ” যৌথ কর্মসূচি পালন করেছে, যেখানে পঙ্কজ ভট্টাচার্য নেতৃত্ব দিয়েছেন।

২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় “সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন” ও “সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ” যৌথভাবে সহিংসতার ঘটনাসমূহ অনুসন্ধান করে। এই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে ‘নির্যাতনের দলিল-২০০১ (নির্বাচন পূর্ব ও নির্বাচন উত্তর সংখ্যালঘু নিপীড়ন)’ নামে একটি প্রামান্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন এবং একই সময়ে গঠিত গণতদন্ত কমিশনের ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন-২০০১-গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন’ প্রকাশিত হয়, যেখানে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রকাশ পর্যন্ত পঙ্কজ ভট্টাচার্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রান্তিক মানুষ, নারী-শিশু, ধর্মীয় ও জাতীগত সংখ্যালঘু, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন অবিচল ও নিবেদিত প্রাণকর্মী।

স্বাধীন বাংলাদেশে সংঘ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তা ও সকল ধর্মাবলম্বীদের সমঅধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাসের নিশ্চয়তা বিধান; নারীর উপর ফতোয়া জারি ও সহিংসাত প্রতিরোধ; সাধু-বাউলদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ; সীতাকু-ের ত্রিপুরা পল্লী উচ্ছেদ ও আদিবাসীদের জমি-পাহাড়-ভূমি দখলের বিরুদ্ধে, মৌলভীবাজারের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর অর্থকরি ফসল পানগাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদ; কুয়াকাটায় আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের দেবালয়Ñসম্পত্তি দখল; পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুর ঘটনাসহ চা বাগান শ্রমিকদের জীবন-যাপন উপযোগী “মানবিক মজুরি” ঘোষণার দাŸি; আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক সালনা জলসা বন্ধ ও বসতিতে হামলা চালিয়ে বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনায় প্রতিবাদসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিকÑপ্রগতিশীল আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনে পঙ্কজ ভট্টাচার্য সক্রিয়ভাবে আক্রান্ত জনপদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তলেছেন।২৪ শে এপ্রিল পঙ্কজ ভট্টাচার্যের শারীরিক প্রয়ান হয়েছে। পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রান্তিক মানুষের জন্য প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠন নিয়ে সারাদেশ হেটেছেন। তার শারীরিক প্রয়ানের পরও তার সহযোদ্ধা ব্যক্তি ও সংগঠন তাঁর দেখানো পথেই মানুষের মুক্তির পতাকা বহন করবেন।

লেখক: আইনজীবি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।

You might also like