পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥দশ॥
সুনামগঞ্জের সমগ্র ভাটি অঞ্চলের হাওরে বর্ষাকালে মাছ ধরা নিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নয়া বিপত্তি শুরু হয়। ইজারাদার ও এলাকার দরিদ্র মানুষের মধ্যে এই ঘটনা বা ঝগড়া-বিবাদ। বিল ইজারা যারা নেয়, তারা বর্ষাকালে জলে একাকার হয়ে যাওয়া হাওরে, দরিদ্র কৃষকদের মাছ ধরতে দেয় না, বাধা দেয়। কৃষকদের কথা হল, ‘পানির নীচে আমাদের জমি, বিল হাওর, জমি একাকার যেটা ‘ভাসানপানি’, সেখানে মাছ ধরা মানে আমাদের জমিতেই মাছ ধরা, ইজারাদারদের বিলে নয়। ইজারাদার তুমিবিল ইজারা নিয়েছো, জমি নয়। এখানে আমরা মাছ ধরবোই। আমরা তো বালবাচ্চা নিয়ে খেয়েপরে বাঁচতে হবে, আমাদের পেটে লাত্তি দিও না।’
কিন্তু ইজারাদাররা একজোট। হাওরে পাহারাদার বসায়, বন্দুক দিয়ে তাড়িয়ে দেয় মাছ ধরতে পানিতে-নামা জালিয়াদের, গুলি করে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেবে, দেয়-ও ওরা। বর্ষা এলেই হাওরে থাকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। থমথমে অবস্থা।
এই হাওরযোদ্ধা, দরিদ্র কৃষকদের জীবনের সাথে জমির জোতস্বত্ব মালিকানা, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের ঘাম শুকায়নি। ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রজাসত্ত্ব আইন, বুকের ধন। যা কবুলিওত বাতিল করা যাবে না, ধান তেভাগা দিতে হবে, জমিদারের অত্যাচার বন্ধ করাসহ বাড়তি খাজনা আদায় বন্ধ আন্দোলন, শেষমেষ জমিদারীপ্রথা উচ্ছেদ। এই কৃষকরক্ষা আন্দোলনের নেতা করুণাসিন্ধু রায়ের হাতে গড়া কৃষক সমাজ আবার নতুন করে দাঁড়ায়, দাঁড়াতে হয় ‘ভাসানপানি’তে মাছ ধরা আন্দোলনে। রুখে দিতে উত্তপ্ত রক্তে শান দেয় পুনরায়। হাইল হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওয়ার, শনির হার, দেখার হাওর, বড় হাওর, নলুয়ার হাওর, মইর হাওরসহ শতাধিক হাওরের সহস্রাধিক কৃষক নাম লেখায় জীবনবাজি-রাখা ‘ভাসানপানি’ আন্দোলনে। এই যুদ্ধের বর্তমান নেতা করুণা সিন্ধু রায়ের পুত্র বরুন রায়—যার পুরো নাম প্রসূন কান্তি রায়। সেই প্রসূন কান্তি রায়ের সহযোগী হলেন আমাদের আলম চৌধুরী। পুরোদস্তুর কৃষক নেতা।
তিনি বরাবর বড় মাছ কিনে ওবাড়ি সেবাড়ি উঠতেন, রান্না করিয়ে মনের মুরাদে খেতেন। কিন্তু যত দিন যায়, তত তিনি বাজারে বড় মাছ কিনতে পান না। মাছওয়ালাদের জিজ্ঞেস করলে তারা নানা অজুহাত দেখায়। এক সময় জানতে পারেন বর্ষার দিনে ভাসান পানিতে মাছ ধরতে ইজাজারাদার দেয় না। কেন দেয় না তা খুঁজতে গিয়ে তিনি ভিড়েন কৃষকদের মরণপণ আন্দোলনে।
হাওরে ‘ভাসান পানি’তে জাল নিয়ে নামা কৃষকদের সঙ্গী আলম চৌধুরী। নানা জাতের মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সঙ্গের জালুয়ারা। তাদের সাথে ছনের ডেরায় ঘুমান, কখনো ঘুমান খেরর ফেইনে, গরুর গোয়ালে। খান মাছ-ভাত, ডাল জুটলে পাতলা পানি রসুনের বাগার। চোখে দেখেন-না দু’টাকার তখনকার নোটও একটা। শুধু হাওর আর হাওর। যার যেভাবে জুটে, সেভাবে তাদের একজন, তিনিও নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছেন। জীবন বদলে নিয়ে হয়েছেন সংগ্রামী, বিপ্লবী। বড় মাছ নিয়ে আর ওঠা হয় না কারো বাড়ি। বেছে বেছে মাছ ভাজি, চমচমে তেলে ভাজা, মচমচে রুইমাছের কোর ভুলেই গেছেন আলম চৌধুরী। এ ভিন্ন অন্যরূপ। আকাশনামা গমগমে আষাঢ়ে বিষ্টি, ভিজতে ভিজতে কাপড়ে বুটকো গন্ধ, রোদ-বৃষ্টি, ঘন অন্ধকার রাতের জগত, নাওয়ের ছৈ উড়িয়ে নেয়া আফালের তেজ সবই সওয়া এখন।(চলবে)